এস কে দোয়েল :
আবহমান কাল ধরে বাঙালি নারীর প্রধান পরিধেয় বস্ত্র শাড়ী। পোশাকে আধুনিকতা এলেও বাঙালির নারীর অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে উঠে শাড়ীতেই। মোহনীয় সৌন্দর্য পুরোপুরি ফুটে উঠে এই শাড়ীতে। পরিধেয় এই শাড়ীতে একজন নারী হয়ে ওঠেন পরিপূর্ণা। সেই পরিপূর্ণতা তৈরিতে টাংগাইলের ঐতিহ্য তাতের শাড়ীর প্রশংসার শেষ নেই। বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে এই তাত শিল্পের শাড়ী। দক্ষিণ এশিয়ার সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ আমেরিকা জয় করেছে বিশ্ব সুনাম অর্জন করেছে টাঙ্গাইলের তাঁত বস্ত্র। তাতীদের অপরিসীম ত্যাগ, নিষ্ঠা ও নিরলস পরিশ্রমের কারণেই টাঙ্গাইলের এককালের সাধারণ মানের তাঁতের শাড়ি আজ বিশ্বখ্যাত শাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিখ্যাত তাতের শাড়ী নিয়ে অনলাইন বিজনেস সেল করে সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন টাংগাইলের সাগরিকা ইকবাল।
২০১৬ সালে কিছু একটা করার চিন্তা করেন সাগরিকা ইকবাল। কিন্তু কি করবেন, ঠিক করলেন নিজ জেলার ঐতিহ্য টাংগাইলের বিশ্বখ্যাত তাতের শাড়ী নিয়ে অনলাইন বিজনেস করবেন। কিন্তু কি কিভাবে? পরিবার সাপোর্ট করবে তো। প্রথম দিকে সাপোর্ট পাচ্ছিলেন না স্বামীরও। কারণ চাকরি, স্বামী ও একমাত্র সন্তান নিয়ে সংসার সামলিয়ে সময় বের করাটাও কঠিন। কিন্তু চোখ জুড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। মনের প্রবল ইচ্ছায় লুকিয়েই মাত্র ৩ হাজার ৪৯০ টাকা দিয়ে শুরু করেন কাজ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একটি এনজিওতে চাকরি করেন সাগরিকা। চাকরির সুবাধে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের ৩৪টি জেলা। এই ভ্রমণের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিগোচর হয় টাংগাইলের তাতের শাড়ি ও থ্রি পিস জনপ্রিয়তার চিত্র। হাটবাজারের দোকানপাটে, শপিং মলে নারীদের প্রিয় পছন্দের যেন টাংগাইলের তাতের শাড়ী। তাই ইচ্ছাশক্তি তৈরি হয় ই-কমার্সের মাধ্যমে টাংগাইলের তাতের শাড়ী বিক্রয় করবেন। তাই একই সাথে চাকুরি, সংসার, বাচ্চা, পড়াশোনা চালিয়ে নেশায় পড়ে যান অনলাইন বিজনেসের। চাকরি-সংসার সামলিয়ে ধীর গতিতে চলতে থাকে অনলাইন বিজনেসের কাজ।
ভাওয়াল মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করে ২০১৩ সালে একটি বেসরকারি এনজিওতে চাকরিতে যোগ দেন সাগরিকা ইকবাল। চাকুরিতে যোগদানের পাশাপাশি উন্মুক্ত থেকে থেকে বিএসএস শেষ করেন। তারপর এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে সমাজকর্ম নিয়ে মাস্টার্স শেষ করেন ২০১৯ সালে। পড়াশোনা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পুরোদমে চাকুরির পাশাপাশি অনলাইনে বিজনেসে মন দেন। ২০২০ সালের জুন জুলাইয়ের দিকে ‘নিজের বলার মত একটি গল্প ফাউন্ডেশন’ গ্রুপে যুক্ত হয়ে তিন মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। গ্রুপে লেগে থেকেই নিজেকে তৈরি করতে থাকেন তিনি।
এনজিওতে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত করেন অফিসের কাজ। এই সময়ের মধ্যে ভাবেন না অন্য কিছু। কর্মস্থলের দায়িত্ব পালন শেষে বাকি সময়টুকু সংসার সামলানোর মধ্য দিয়ে বেছে নেন অনলাইন বিজনেসের কাজ। কাজ করেন রাতজাগার পাখির মতো। যতক্ষণ জেগে থাকা ততক্ষণই কাজ করেন তিনি। পুরো রমজান মাস সেহেরী খেয়ে মাত্র ২ ঘন্টা ঘুমাতে ঘুমিয়েছিলেন শুধু স্বপ্ন পূরণের লক্ষে পৌঁছাতে।
স্বপ্ন পূরণের অক্লান্ত পরিশ্রমে অবশেষে পৌছে গেছেন সফল নারী উদ্যোক্তাদের কাতারে। অনলাইনে ব্যবসা প্রসারের জন্য ফেসবুক পেজের নাম দিয়েছেন ‘শখের হাট’। ফেসবুক পেজ ও নিজের আইডিতে প্রচুর ফলোয়ার থাকায় বেশ সাড়া মেলেছে ক্রেতাদের। প্রতি মাসে তাতের শাড়ি ও থ্রি-পিস অনলাইন সেল হয় লাখ টাকার উপরে। এ রমজান মাসে সেল হয়েছে দেড় লাখ টাকার উপরে। আর তা ৯০% সেলই হয়েছে ‘নিজের বলার মত একটি গল্প ফাউন্ডেশন’-গ্রুপের মাধ্যমে।
সাগরিকা ইকবাল জানান, প্রথম দিয়ে আমার স্বামী সাপোর্ট না করলেও এখন পুরোদমে সাপোর্টসহ বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করছে। তিনি আরো জানান, প্রথম ৪ মাসে টাকাটা দিগুন হয়ে গিয়েছিলো। যেহেতু অনলাইন বিজনেস তাই কোন লোকসান গুনতে হয়নি। তাই ধৈর্য-শক্তি ও নিজের ইচ্ছে শক্তি আমাকে নতুন ভাবে নিজের পরিচয় তৈরি করে দিয়েছে। আর আমি সম্পূর্ণ তাতীদের নিয়ে কাজ করি। যার কারনে দামে অনেক কম ও মানেও ভালো পায় ক্রেতারা। প্রায় প্রতি মাসেই লাখ টাকার সেল হয়। আর আমার রিপিট কাস্টমারও বেশি। টাংগাইলে অবস্থানের কারণে সকল শাড়ি ও থ্রি পিস খুবই সীমিত লাভে সেল হয়। কারন ক্যারিং খরচ বেশি হয় না। পাইকারি ও খুচরা মূল্যে দুটোই দিয়ে থাকি ক্রেতাদের।
ভবিষ্যত পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে সাগরিকা জানান, চাকরি নয়, নিজে সফল উদ্যোক্তা হতে চাই। এ জন্য ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ পুজির প্রয়োজন হয়। ইচ্ছে আছে এখানকার পিছিয়ে পড়া নারী ও শিক্ষিত বেকার মেয়েদের আত্ম-কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার। সরকার তো উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, উদ্যোক্তা হিসেবে সরকারি সহযোগিতা পেলে কাজের আরো গতি পাব।
সময় জার্নাল/এসএ