মামুনূর রহমান হৃদয়: গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম মাটির ঘর। চারপাশে মাটির দেয়াল ও উপরে টিনের বা ছনের ছাউনি বয়োজৈষ্ঠদের মনে করিয়ে দেয় তাদের ছেলেবেলা। অত্যাধিক শীতে ঘরের ভিতর তুলনামূলক উষ্ণ পরিবেশ ও গরম কালে স্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করার কারণে মাটির ঘর গরীবের কাছে যেমন আরম প্রিয় ছিলো, তেমনি কিছু ধনীর ছিলো বিলাসিতার অংশ। তবে যুগের সাথে তাল মেলাতে না পেরে মাটির ঘর এখন বিলুপ্তির পথে।
এক সময় গ্রাম বাংলার প্রতিটি বাড়িতেই দেখা যেত এই মাটির ঘর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে; পূর্ব পুরুষের তৈরি ঘরগুলো বিত্তশালীরা ইট, বালু, রড, সিমেন্টের ঘরে রূপান্তরিত করেছে। আর যারা পাকা বাড়ি করতে পারছেন না তারা তৈরি করছেন টিনের ঘর। তবে এখনো কিছু জায়গায় মাটির ঘর টিকে আছে ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় রুপগঞ্জ উপজেলার ভূলতা ইউনিয়নের পাচাইখাঁ এলাকায় রয়েছে কিছু মাটির ঘর। একচালা ঘরটি চারদিক দেয়াল উপরে টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি ঘরগুলো দেখতে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতোই সুন্দর লাগে দেখতে। বাড়ির বর্তমান মালিকের নাম মোখলেস মিয়া। তার পিতা মৃত লাল মিয়া বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন মিয়া জানান, পৈতৃক সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত এই মাটির ঘর যুগের পর যুগ ইট-পাথরের দালানের সাথে তাল মিলিয়ে টিকে আছে। পানির সাথে মাটির প্রলেপ মিশিয়ে লেপে নিলেই কোনো ফাটল দেখা যায় না। কোনো কোনো সময় অতিবৃষ্টি কিংবা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরগুলো বেশি নষ্ট বা ফেটে গেলে সিমেন্ট দিয়েও লেপে দেন অনেকে বলে জানান তিনি।
একসময় মাটির ঘর তৈরি করতেন চান্দিনা উপজেলার কৈলাইন গ্রামের চৌধুরী বাড়ির হাসেম মোল্লা (৭৫)। তিনি বলেন, যারা মাটির ঘর নির্মাণ কাজ করেন তারা 'দেল বারুই' নামে পরিচিত। সচরাচর এঁটেল মাটি দিয়ে এসব ঘর তৈরি করা হতো। পরিচ্ছন্ন মাটির সঙ্গে পানি মিশিয়ে কাদায় পরিণত করে ইটের মত সারি সারি করে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল তৈরি করা হয়। প্রতিবারে এক-দেড় ফুট উঁচু করে ক্রমে শুকিয়ে গেলে খড় বা টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া হতো। প্রতিটি ঘর তৈরিতে দেড়-দুই মাস সময় ব্যয় হতো। তবে মুষলধারে বৃষ্টি কিংবা ১৯৮৮ অথবা ১৯৯৮ এর মতো বড় বড় বন্যায় ঘরের স্বাভাবিক কাঠামো নষ্ট হওয়ায় লোকজন মাটির ঘর তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
তিনি আরো বলেন , এখন সবার ঘরই ইট-পাথরের দালানে তৈরি। আর যাদের ইট-পাথরের দালান নেই তারাও পাড়া-প্রতিবেশী, স্থানীয় সমিতির থেকে ঋণ নিয়ে তৈরি করছেন টিনের নকশা করা বাড়ি।
তবে এখনো কিছু বাড়ি দেখা যায় স্মৃতি বহন করতে। তার মধ্যে অন্যতম নওগাঁর ১০৮ কক্ষের মাটির প্রাসাদ। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের আলিপুর গ্রামে ৩৩ বছর ধরে টিকে আছে বাড়িটি। এছাড়াও বগুড়ার নন্দীগ্রামে ১২ শতক জমির উপর তিনতলা মাটির ঘর দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম।
এছাড়াও পার্বত্যচট্টগ্রাম, রাজশাহীর তানরের দ্বিতল বাড়ি, নাটোরের সিংড়া উপজেলার মাটির তৈরি বিদ্যালয়, সাভার, নারায়ণগঞ্জের মহজমপুর, ললাটি, নানাখি, আড়াইহাজার থানার কালীবাড়ি, নরসিংদীর মাধবদী, গাউছিয়া ছাড়াও যশোরের মনিরামপুর গ্রামে দ্বিতল লাল মাটির ঘর এখনও টিকে আছে। যা পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি বহন করছে।
লেখক: মামুনূর রহমান হৃদয়, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী
সময় জার্নাল/এমআই