দরিদ্রের দৃষ্টিতে ঈদ। মিজানুর রহমান সিনহা
দীন দুখীর জন্য ঈদ বা অন্যান্য উৎসব আনন্দের চেয়ে বেদনাই বেশি। কারণ, যেখানে বড়লোকের অতি দামি জামাকাপড়, নানান ধরণের খাবার আর জাঁকজমকপূর্ণ জীবনে নিজেদের ডুবিয়ে রাখে, সেখানে অভাবের তাড়নায় তাড়িত হয়ে সংসার আর বাচ্চাদের নিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করার নাই। তাদের পক্ষে সন্তানদের আবদার পূরণ করা আর দূর আকাশের তারা ছুঁয়ে দেখার মতই।
সন্তানকে একটু ভালো খাবার আর পোশাক কিনে দিতে না পারার আক্ষেপ ও অসহায়ত্ব তিলে তিলে কুঁড়ে খায়। এটা সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত থাকা কারো জন্য বুঝা সহজ কাজ নয়।
কয়েক মাস আগের কথা, যখন আমি একটা বাসা ছেড়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন পাশের ফ্লাটের ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞেস করলো, ভাই আপনি চলে যান? আর আমার কি কপাল! না পারছি গত ছয় মাসের ভাড়া দিতে, না পারছি চলে যেতে। গ্রামের জায়গা জমিন বিক্রি করে এতোদিন চলেছি, এখন আর সম্ভব নয়.... একটানা বলতে থাকলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তার ভাষ্য মতে, কোনো রকম আলু ভর্তা, ডাল আর মাঝে মাঝে চারজনের জন্য দুটা ডিম দিয়ে ভাত খেয়ে ক্ষুধা মিটাতে হয়। আমিশের চাহিদা পূরণ করার কথা ভাবাই অবান্তর। এছাড়াও মেয়ে ও ছেলেটাকে স্কুলে পড়ানোর খরচ দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। অথচ কখনো বুঝতেই পারিনি এই মানুষটি এতোটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছে। যদিও প্রতিবেশী হিসেবে মাঝে মাঝে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করতাম, তাও তার ছেলের আমার বাসায় আগমনের সুবাধেই।
বেশিরভাগ পরিবারের ওপর দিয়ে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় যাচ্ছে বাজারের উর্ধগতির ফলে, অথচ আয় ততটা বাড়েনি। আমরা বিশ্বের অস্থিরতার কথা বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যাই। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছেতে কোথাও যেন ঘাটতি রয়েছে। এমন অনেক পণ্য আছে, যেগুলো ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত নয়, সেগুলোও এখন চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
আমরা প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে দূর্নীতিবাজ। অন্যকে ঠকিয়ে নিজের আখের গোছাতে সদা জাগ্রত। রমজান উপলক্ষে মুসলিম বিশ্বে এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতে নানান পণ্যে ছাড় দেয়, সেখানে ভিন্ন চিত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এখানে অসাধু ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে, একেবারে সারা বছর চলার মতো লাভ করে নেওয়ার জন্য। দিনদিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে প্রত্যেকটা পর্যায়ে।
ঈদের এই আনন্দ একা ভোগ করতে গিয়ে অন্যের অশ্রু ঝরানোর কারণ যেন না হতে হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। সামর্থ্যের মধ্যে প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বা অস্বচ্ছল পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারার মাঝে যে আনন্দ খুঁজে পাবেন, তা একাকী আনন্দের চেয়ে শতগুণ সুখের। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে সব কিছু শেয়ার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা অভাবীদের মনের অজান্তেই কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । তাই কাউকে কিছু না দিতে পারলেও পরাণে প্রলয় সৃষ্টির কারণ না হওয়াই উত্তম।
কবি ও লেখক: মিজানুর রহমান সিনহা
সাবেক শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়