আমেরিকান কবি অগডেন ন্যাশ তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন,"এনি কিড ইন স্কুল ক্যান লাভ লাইক অ্যা ফুল, বাট হেটিং মায় বয় , ইজ অ্যান আর্ট," - অর্থাৎ স্কুলে পড়া যে কোনও শিশু একেবারে বোকার মতো ভালবাসতে পারে, কিন্তু ঘৃণা করা একটি শিল্প, সেটা রীতিমতো অনুশীলন করতে হয়। রাজনীতির প্রয়োজনে ইতিহাস চর্চা যখন জরুরী হয়ে পড়ে এবং রাজনীতির কারবারিদের ইতিহাসের পুনঃনির্মাণ যজ্ঞে সামিল হতে হয়, অতীতকে নতুনভাবে উপস্থাপন করার তাগিদে বিভাজন সৃষ্টির লক্ষে ঘৃণার অনুশীলন করতে হয়। এই ঘৃণার বিষবাষ্পে ইতিহাস চর্চার সকল সৌন্দর্যের ধারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সেই পর্যায়ে কবির অন্তরের উপলব্ধি আর কল্পনার জগতে সীমাবদ্ধ না থেকে নির্মম বাস্তবতায় উদ্ভাসিত হয়।
ঐতিহাসিকগণ কোনও ঘটনার ক্রম ও পরিণতিকে পরিবর্তন করতে না পারলেও কোনও ঘটনা সম্বন্ধে বর্তমানের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এটাই ইতিহাসের নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ খেলা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইতিহাস বড্ড মসনদের চারপাশে বিচরণ করে থাকে। তাই, মসনদ থেকেই ইতিহাস চর্চার ধরন ও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হবে -এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতি নামক তথাকথিত পুণ্য কর্মে তাই চাতুরীতার অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে। কাজেই, ইতিহাসকে যখন রাজনীতির পাঠশালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, ইতিহাস তখন তার সরল পথ পরিহার করতে বাধ্য হয় এবং গলিপথে চলতে থাকে। এই প্রসঙ্গে টিএস এলিয়ট এর কবিতার একটি লাইন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে,"ইতিহাস অজস্র চতুর ও মেকি গলি পথের প্রহেলিকা"(বঙ্গানুবাদ)
ইতিহাসের প্রাণ সত্য হলেও রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় ঐতিহাসিকগণ আপন মূল বিচার কে ইতিহাসের সত্যের সঙ্গে যোগ করে থাকেন। ইতিহাস তাই রূপ পাল্টায়। প্রকৃত অর্থে ইতিহাস কোনও বাঁধা ধরা ছক মেনে চলে না। ঐতিহাসিকগণই ইতিহাসের গতিপথে ছক সৃষ্টি করে থাকেন। একথা নির্মম হলেও সত্য, রাজনীতির প্রয়োজনে এই ছক নানা খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। রাজনীতির কারবারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস চোরাপথে বিচরণ করতে থাকে। ইতিহাস বিকৃতির খেলায় মিথ্যাকে সত্যের জালে আটকাতে অথবা সত্যকে মিথ্যার মোড়কে আবদ্ধ করতে ইতিহাস চর্চা আগ্রাসন নীতির হাত ধরে ঘৃণা বর্ষণ করতে থাকে। বাংলার জনৈক চারণ কবির কথাই যেন বাস্তব রূপ লাভ করে," কেউ সত্য কথা বলে সত্য, মিথ্যা বলে তাও সত্য, সত্য-মিথ্যা দুই সত্য"।
রাজনীতির পাঠশালা তে ইতিহাস চর্চায় মুক্ত মনের দরজা কার্যত বন্ধ বরং উগ্র জাতীয়তাবাদের ভাবধারাই পুষ্ট। ইতিহাস লব্ধ জ্ঞান যা সভ্যতা নির্মাণের ভিত্তি সেই জ্ঞানকে প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সম্মুখীন হতে হয়। ইতিহাস চর্চার ধরনকে মনগড়া ধাঁচে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। আধুনিক ইতিহাস চর্চার জনক ইবনে খালদুনের সতর্কবাণী,"ঐতিহাসিককে হতে হবে গভীর অনুসন্ধিৎসু, বৈজ্ঞানিক মনস্ক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী"- এই শাস্বত নীতিকে উপেক্ষা করে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাসের পুনঃনির্মাণ লক্ষ্যে ইতিহাসকে মানবীয় মূল্যবোধের পাঠশালায় না রেখে কার্যত রাজনীতির পাঠশালায় ঠাঁই দেওয়া হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীদের অতীত নির্মাণের স্বঘোষিত নীতিমালায় অভূতপূর্বভাবে কাটছাটের কৌশল চলছে। যে মতাদর্শের সাথে তাদের মিলছে না, তাকে সদর্পে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনীতির সেবকবৃন্দ রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে অপরাধী করা হচ্ছে। এ কে রামানুজের "থ্রি হান্ড্রেড রামায়ণ জ"প্রবন্ধ, পাঠক্রম থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। বিপানচন্দ্র , রোমিলা থাপার সহ একাধিক মার্কসবাদী ঐতিহাসিকগণদের, মুসলিম ও পশ্চিমী ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস বই পুড়িয়ে ফেলার দাবি জোরদার হচ্ছে। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চার উপরে সাম্প্রদায়িক শক্তির হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে রচিত রামশরণ শর্মার গবেষণাধর্মী লেখার উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
মানবীয় বিদ্যচর্চার জগতে অন্যতম প্রধান শাখা ইতিহাস অনুসন্ধিৎসার প্রতি অভূতপূর্বভাবে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। জ্ঞান অন্বেষণের বৃহৎ উৎস হিসেবে বিবেচিত ইতিহাস চর্চার উন্মুক্ত দরজা বর্তমানে কার্যত বন্ধ। উগ্র জাতীয়তাবাদের ভাবধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন যেকোন মতাদর্শের প্রতি নেমে আসছে আগ্রাসন। রোমিলা থাপারের কথায়,"যে পৃথিবীতে আমরা বসবাস করি, তাকে প্রশ্ন না করলে জ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন সভ্যতা কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা বোঝার জন্য বিরুদ্ধতা নিয়ে চর্চা একান্ত প্রয়োজন"। এই চিরন্তন তথা শাশ্বত সত্য উপলব্ধি ও তার বাস্তবায়নের পথ অবরুদ্ধ। প্রশ্ন উত্থাপন এবং তাত্ত্বিক অনুসন্ধান করা ও ভিন্নতর অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করতে গিয়ে মতানৈক্যের বৃহত্তর ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়া একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সেখানে অসহিষ্ণুতার তরবারি প্রদর্শন করে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হলে মুক্তচিন্তার পরিবেশ শুধু দূষিতই হবে না, ধ্বংসও হবে।
ঐতিহাসিক ই এইচ কারের মতে , "ইতিহাস হল অতীতের সঙ্গে কথোপকথন" । এই জন্যই মনে হয় সভ্যতার প্রগতির প্রশ্নে ইতিহাস বারবার ফিরে আসে। বারবার ফিরে আসে বলেই তার থেকে বারে বারে শিক্ষাও নিতে হয়। শিক্ষা নিতে গেলে যে প্রশ্ন করতেই হয়। তাই প্রশ্ন করার অধিকারও সর্বজনীন এবং অবাধ হওয়া একান্ত দরকার। সভ্যতার চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত এই ধ্রুব সত্যকে বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্র যদি ইতিহাস চর্চার একচেটিয়া অধিকার তার নিজের কাঁধে তুলে নেয়, তাতে রাজনীতির কারবারের শ্রীবৃদ্ধি হলেও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের যে সলিল সমাধি হবে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিশ্বের যে কোন সমাজের মতোই ভারতীয় সমাজেও নির্ভেজাল ঐক্য ও সম্প্রীতির সমাহার ঘটেনি। অসহিষ্ণুতা ও হিংসার ইতিহাস আমাদের সমাজেও কম বেশি ছিল। চিন্তা-চেতনার জগতে বিরুদ্ধ স্বরের অস্তিত্বও ছিল। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, এর পাশাপাশি সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের উজ্জ্বল ধারাটিও বেশ মজবুত ছিল। যুগে যুগে রাজনৈতিক পালা বদলের হাত ধরেই শাসকগোষ্ঠী, তারা যে ধর্মের ও জাতের অনুসারী হোক না কেন প্রাথমিক অসহিষ্ণুতা অতিক্রম করে সমন্বয়ের আদর্শকে অনুসরণ করেছেন। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা বাদ দিলে আমজনতাও মূলত সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকার প্রয়াস চালিয়েছে। এটাই আমাদের চিরাচরিত গ্রামীণ সমাজের নির্মল ঐতিহ্য। অমর্ত্য সেনের ভাষায় যেটা একটি সামাজিক শক্তিও বটে। এর বিপরীতে চলার অর্থই হল আমাদের চিরাচরিত ঐতিহ্যের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করে দেওয়া।
বহুত্ববাদী চেতনার আলোকে আলোকিত সমন্বয়ের উজ্জ্বল ধারা আমাদের এই পুণ্যভূমির প্রগতির মূল উৎস। যুগে যুগে সমন্বয় সাধকগণ এই চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ভক্তিবাদ, সুফীবাদের হৃদয় ভেদ করে মরমী সাধক ও দার্শনিকগণ তাঁদের গানে, কবিতায়, দর্শনে ও শিল্পকর্মে ভারতীয় জন মানসে এমনভাবে গেঁথে আছেন যে, শত বিচ্ছিন্নতার ধারা তার মৌলিক প্রবাহকে বিনষ্ট করতে পারেনি। একাধিক শাসক এই সমন্বয়ের ও সহিষ্ণুতার ধারাকে অনুসরণ করে অমর কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক সম্পর্কগুলো গ্রথিত হয়ে আসছে মূলত দুটি ভিন্ন পক্ষের মধ্যে যথা- সম্পদের মালিকানা ও ক্ষমতাহীনদের দ্বন্দ্ব । এই ছিল তার মূল ভিত্তি। এই পারস্পরিক দ্বন্দ্বে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগত প্রশ্ন সংযোজিত হয়ে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে এমনকি নবজাগরণ পর্বে ভারতে ইতিহাস চর্চার ধারা এক নতুন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের গঠন ও নতুন সমাজ গঠনে যে সূত্র গুলির মাধ্যমে একসাথে গাঁথার কথা ভাবা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হল জাতীয়তাবাদ বা মানুষের কোন একটি বিশেষ জাতিরাষ্ট্রে অংশীদারিত্বের বোধ। স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল ধারায় এই জাতীয়তাবাদী চেতনা তাই একটি বলিষ্ঠ রূপ লাভ করেছিল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী দিনগুলিতে বিশেষ করে চলমান সময়ে রাজনীতির প্রশ্নে জাতীয়তাবাদ আর উগ্র জাতীয়তাবাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সমন্বয় সাধকদের মুখনিঃসৃত বাণী, নীতি ,আদর্শ ইতিহাসের পাঠক্রমে স্থান পাচ্ছে না। সমন্বয় নীতির অনুসারী শাসকদের উজ্জল কার্যকলাপেরও স্থান নেই। এই সূত্র ধরেই মুঘল ইতিহাস বিসর্জনের পথে কিন্তু শিবাজীর ইতিহাস হিন্দুত্ববাদের হৃদয়ে হৃদয়-সম্রাট হিসেবে পাকাপোক্তভাবে স্থান পাচ্ছে। ইতিহাসের এ এক নির্মম পরিহাস।
রাজনীতির পাঠশালায় ইতিহাসের বৃহত্তর জগতে অবাধ স্বাধীনতার পরিবেশে মানবীয় মূল্যবোধের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত বরং সংখ্যাগুরুর আবেগ জাগরণে ইতিহাসের পুনঃনির্মাণ খেলা অত্যন্ত ফলপ্রসু। ইতিহাসের এই পাঠশালায় ইতিহাসকে সুন্নির্দিষ্ট ছকে ফেলে পুনর্নির্মাণ করতে হয়। সমন্বয়, সম্প্রীতি, সহাবস্থান - যে বিষয়গুলো বেঁধে বেঁধে থাকার প্রেরণা যোগায় সেই চেতনাকে লালন পালন করার তাগিদ এই পাঠশালার পন্ডিতদের একেবারেই না পসন্দ, বরং এই চেতনাকে সমূলে উৎপাটন করার অদম্য ইচ্ছা তাদের মানসিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে থাকে।রাম-রহিমের গলাগলি তাদের মাথাব্যথার কারণ হলেও তাদের মধ্যে বিভাজন নীতি অনুসরণ পুণ্যকর্ম হিসেবে চিহ্নিত। তাই রাজনীতির পাঠশালায় ইতিহাসের পাঠক্রমকে হিংসার উপাদানে রঞ্জিত করতে হয়। অহিংসার বীজ বপন করে গান্ধীজি আমাদের জাতীয় জীবনে জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘাটালেও অধুনা সেই ঐতিহ্য উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। "ন্যাশনালিজিম"গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতা বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদের সতর্কবার্তা গুরুত্ব হারায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরব গাঁথা বিস্মৃতির অন্তরালে চাপা পড়ে থাকে। কিন্তু বিভাজন নীতির উর্বর মৃত্তিকায় আমরা-ওরা সুস্পষ্ট সীমারেখার চাষাবাদ নতুন মাত্রা পায়।
বিদ্বেষ ও বিভাজন নীতির অনুসারীদের বিষবাষ্পের উত্তাপে দেশের সুশীল সমাজ গঠনের পথ ত্বরান্বিত হতে পারেনা বরং অন্তরায় সৃষ্টির সম্ভাবনা প্রবল। আগামী দিনের ভারতবর্ষ শিশুর বাসযোগ্য হয়ে থাকবে কিনা, এটা একটা বড় প্রশ্ন। কারণ নবনির্মিত ইতিহাসের পাঠশালায় মানসিক বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় মূল্যবোধের শিক্ষা, মানবতাবাদী চেতনা ও গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যের উপকরণের বড্ড অভাব। এ প্রসঙ্গে ইরফান হাবিবের সতর্ক বার্তাটি তাই একটি স্বতন্ত্র তাৎপর্য বহন করে বইকি,"ইতিহাস না জানলে ক্ষতি নেই, কিন্তু ভুল ইতিহাসের চর্চা ও বিকৃত ইতিহাসের চর্চা সভ্যতার সংকট সৃষ্টি করতে পারে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই"।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, মুর্শিদাবাদ।