মো. মাইদুল ইসলাম:
ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সরকারের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাতগুলোর মাঝে অন্যতম হল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ গত অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে চারশ নব্বই কোটি টাকা। এই খাতে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, দেশে ক্রমশ বাড়তে থাকা ব্যান্ডউইথের চাহিদা মেটানোর জন্য ২০২৮ সাল নাগাদ দেশের চতুর্থ ও ২০৩৩ সাল নাগাদ পঞ্চম সাবমেরিন কেবল স্থাপন প্রকল্প গ্রহণসহ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বানও করা হয়েছে বাজেটে।
অন্যদিকে এই বছরের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল করমুক্ত থাকা বা না থাকার বিষয়টি। আগামী ৩ বছরের জন্য অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই খাতের মোট ২৪ টি পরিষেবা কর-অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে।
তবে ক্যাশলেসে করমুক্তি, আইসিটি সেক্টরের সব সাব-সেক্টরকে করমুক্তির আওতায় না রাখা, ইন্টারনেটের মূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়গুলোতে সংকাশ ফেলে দিয়েছে আইটি উদ্যোক্তাদের।
এআই সলিউশন ডেভেলপমেন্ট, ব্লকচেইন সলিউশন, সফটওয়্যার অ্যাজ এ সার্ভিস (SaaS) এবং ডেটা সায়েন্সের মতো উদীয়মান প্রযুক্তির ট্যাক্স এক্সেম্পশনের অধীনে অন্তর্ভুক্তি দ্রুত বিকশিত প্রযুক্তির ল্যান্ডস্কেপে এগিয়ে থাকার জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতির একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত। এই কৌশলগত পদক্ষেপটি কেবল বিদ্যমান আইটি ব্যবসাকে সমর্থন করে না বরং নতুন উদ্যোগ এবং স্টার্টআপগুলিকেও আকর্ষণ করে, একটি প্রাণবন্ত এবং গতিশীল প্রযুক্তি ইকোসিস্টেমকে উৎসাহিত করবে।
সরকারের ভিশন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার, স্মার্ট এডুকেশনসহ স্মার্ট হিউম্যান রিসার্চ। আর এগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক বিকাশ। কিন্তু ওয়েব হোস্টিং, ক্লাউড পরিসেবার মত সেক্টরগুলোতে করারোপ করলে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য রিসার্চের পেছনে পর্যাপ্ত খরচ কোম্পানিগুলো করতে পারবেনা, যেটা এতদিন করা সম্ভব হতো।
এ বিষয়ে তথ্য প্রযুক্তিবিদ ই-গভর্ন্যন্স সিস্টেম আর্কিটেক্ট (ভার্চুয়াল কোর্ট, ডি-নথি প্রভৃতি) ও ট্যাপওয়্যার সলিউশনস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিটন মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, "আমি মনে করি, সরকারের "স্মার্ট বাংলাদেশ" এর ভিশন উচ্চাভিলাষী এবং অনুপ্রেরণাদায়ক। এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে রাজস্ব নীতির সারিবদ্ধতা, বিশেষ করে ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন, উচ্চগতির ইন্টারনেট, ডেটা সেন্টার এবং সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য প্রণোদনা, ২০৪১ সালের মধ্যে $৫০ বিলিয়ন ডিজিটাল অর্থনীতি অর্জনের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করবে। এই উদ্যোগগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি করে। এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করে যে বাংলাদেশ বৈশ্বিক মঞ্চে প্রতিযোগিতামূলক রয়েছে, স্থানীয় এবং বিদেশি উভয় বিনিয়োগকে আকর্ষণ করবে।
তবে এটা ও উপেক্ষা করার মতো নয় যে, ওয়েব হোস্টিং এবং ক্লাউড পরিষেবাগুলির মতো প্রয়োজনীয় সেক্টরগুলিকে ট্যাক্স এক্সেম্পশন থেকে বহির্ভূত করার ফলে বাংলাদেশের আইটি শিল্পের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ উপস্থাপিত হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলি পুরো আইটি ইন্ডাস্ট্রির উপর প্রভাব ফেলবে কারণ বাংলাদেশ আইটি কোন একক সত্তা নয়।"
তিনি বলেন, " আইটি সেক্টর যেহেতু একটা নতুন সেক্টর তাই এটাতে সরকার বরাবরই একটা প্রণোদনা দিত। যেমন ট্যাক্স এক্সেম্পশন, যেটা উঠতি কোম্পানিগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এই কর অব্যাহতি আরও তিন বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে এবছরের বাজেটে। তবে বৃদ্ধির মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমও তৈরি হয়েছে। প্রথমত এটা একটি কন্ডিশনাল এক্সেম্পশন, যেখানে কোম্পানিগুলোর ক্যাশলেস ট্রান্জেকশন করতে হবে। যেহেতু আইটি একটি পরিবার, এখানে সবগুলো সাবসেক্টরেরই সমান ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এক্সেম্পশন এর ক্ষেত্রে কিছু কিছু সাবসেক্টরকে বাদ দেয়ায় কারও কারও জন্য সুবিধা হলেও পুরো তথ্যপ্রযুক্তির জন্য এটা সুবিধাজনক হয়নি। আমাদের একটি লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ হব। এখন স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো আইটি সেক্টর। যেটা কে আমরা বলি ক্রশ কাটিং ইন্ডাস্ট্রি। স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার, স্মার্ট হেলথ, স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন ইত্যাদি সব মিলে কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশে আমার স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার হলো কিন্তু আমাদের লজিস্টিক স্মার্ট হলো না, ট্রান্সপোর্টেশন গতানুগতিক রয়ে গেল। তাহলে কিন্তু গ্রোথ হবে না। তাই স্মার্ট বাংলাদেশের পুরো ইকোসিস্টেমে আইটি গুরুত্বপূর্ণ তাই এর প্রত্যেকটি খাতকে সমানভাবে সুযোগ দেয়া উচিত।
ইন্টারনেটের দাম বাড়ার কারণে আইটির একটা খাতের খরচ বেড়ে গেলে এর প্রভাব পড়বে অন্যগুলোতেও। সেজন্য এখনো যেহেতু আরও কয়েকদিন সময় রয়েছে, বাজেটে তথ্য প্রযুক্তির সাবসেক্টর সবাইকে অন্তত আগামী তিন বছর কর অব্যাহতির আওতায় রাখা উচিত।"
কর অব্যাহতি তিন বছরের চেয়ে আরও বৃদ্ধির বিষয়ে এই প্রযুক্তিবিদ মনে করেন, " অবশ্যই এটা আরও বৃদ্ধি করা উচিত। কারণ, আইটিতে মূল ইনভেস্টমেন্ট হিউম্যান রিসার্চ। আর এটা যেহেতু কোন মেশিনারিজ না, তাই ব্যাংক কোনো লোন দেয় না। যা অন্য সেক্টরের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় । তাই সরকারের এই করমুক্তি পুরো সেক্টরের জন্য একটা বেনিফিট নিয়ে আসবে। এটা সরকারের পক্ষ থেকে একটা ইনভেস্টমেন্ট। যেমন সরকার বড় বড় প্রোজেক্ট, পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে এগুলোতে ইনভেস্ট করেছে, এটাও তেমন।"
বাজেটে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বললেও, আইটির সব সেক্টরকে করমুক্তির আওতায় না রেখে সে প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হবেনা বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, " আমরা কর অবকাশের ফলে যে টাকাটা পাচ্ছি সেটা রিসার্চে ব্যবহার করি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের রিসার্চের পার্ট হিসেবে এআই, মেশিন লার্নিং, ব্লক চেইন এগুলো একেকটা টুল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য এগুলোর প্রয়োজনীয় যে গবেষণা দরকার এই ফান্ড থেকে সেটা করতে পারছি, কিন্তু এগুলোকে পরবর্তী স্টেপে নিয়ে যেতে অন্যান্য সহায়তাও দরকার। যেমন, ক্লাউড, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ এগুলোর খরচ বেড়ে গেলে আমাদের বেশি ভালো কিছু নিয়ে আসবে না।"
দেশের ডাটা সরকার দেশের ভেতরে রাখতে চাইলেও ওয়েব হোস্টিং, ক্লাউড এগুলো করের আওতায় থাকলে দেশের ডাটা বিদেশিদের হাতে আরও বেশি যাবে কিনা এ বিষয়ে মি. নিটন বলেন, বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টর ৮-১০% ক্লাউড সার্ভিস দিতে পারে। বাকি ৯০ শতাংশ বিদেশের ক্লাউড হোস্টিং রয়েছে। এই ৮-১০ শতাংশ বাংলাদেশের যে মার্কেট সেটাও কমে যাবে। কারণ, মেইনটেনেন্সের খরচ বেড়ে গেলে সেটা গিয়ে যে সার্ভিস নিবে তার উপরে পড়বে। তখন বিদেশিদের সার্ভিস নিতে হবে। আর বিদেশের সার্ভিস নিলে যেটা হয়, ফরেন কারেন্সিতে পে করতে হয় কিন্তু আমরা চাইনা ফরেন কারেন্সিতে পে হোক। তাই এ বিষয় মাথায় রেখে ক্লাউড হোস্টিংয়ে বেশি প্রণোদনা দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। সাইবার সিকিউরিটি, ক্লাউড এগুলো ভবিষ্যতের ব্যবসার অপরচুনিটি এবং তরুণরা এআইর মত অ্যাডভান্স টেকনোলজি ব্যবহার করে ডেটা সেন্টার সম্পর্কিত সমাধান তৈরি করবে। এবং কিভাবে ডাটা সিকিউর করা যায়, কিভাবে খরচ কমিয়ে ডাটা দেশে রাখা যায় সেগুলো নিয়ে কাজ করবে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশি ও বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই প্রণোদনাগুলি অপসারণ করা বিনিয়োগকারীদেরকে নিরুৎসাহিত করতে পারে যারা আরও অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ খুঁজছেন, যার ফলে মূলধনের প্রবাহ হ্রাস পাবে এবং শিল্পের বৃদ্ধি মন্থর হবে বলে মনে করেন এই প্রযুক্তিবিদ।
তার মতে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগ (এসএমই) এবং স্টার্ট-আপ, যা উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কর অব্যাহতি অপসারণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই ব্যবসাগুলি প্রায়ই সীমিত বাজেটের সাথে কাজ করে এবং কার্যকর ও প্রতিযোগিতামূলক থাকার জন্য ট্যাক্স বিরতির উপর প্রচুর নির্ভর করে।
এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। উচ্চ পরিচালন ব্যয় এবং হ্রাসকৃত বিনিয়োগ আইটি কোম্পানিগুলির ধীরগতির বৃদ্ধি বা আকার হ্রাস করতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে কম কাজের সুযোগ এবং সম্ভাব্য ছাঁটাই হতে পারে, যা সামগ্রিক চাকরির বাজারকে প্রভাবিত করবে।
কামরুজ্জামান নিটন বলেন, আমরা সবাই বিশ্বাস করি, উদ্ভাবন এবং ডিজিটাল রূপান্তর আইটি সেক্টরে বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। তবে, নতুন বাজেটের দ্বারা আরোপিত বর্ধিত আর্থিক বোঝা এই প্রক্রিয়াগুলিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক অগ্রগতি হারাতে পারে যারা কর প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে আইটি প্রকল্পের স্থানান্তর হতে পারে এবং আরো অনুকূল কর ব্যবস্থা সহ দেশগুলিতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা করার স্থানীয় শিল্পের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। উচ্চ খরচ এবং হ্রাস বিনিয়োগ আইটি কোম্পানিগুলির উদ্ভাবনের ক্ষমতা সীমিত করতে পারে।
যদিও ২০২৪ সালের বাজেটের লক্ষ্য ট্যাক্স নীতিগুলিকে যৌক্তিক করা, কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট সেক্টরে কর অব্যাহতি বাদ দেওয়া বাংলাদেশের আইটি শিল্পের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে ।
এমআই