মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা:
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে গত তিনদিনের টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরাবাসীর জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। অঝর বৃষ্টিতে শহরের নিন্মাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না কেউ। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষগুলো। এছাড়া অতিবৃষ্টিতে ভেসে গেছে জেলার হাজারও মৎস্য ঘের ও পুকুর। বিভিন্ন উপজেলার বিলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে বেতনা নদীর বেড়িবাঁধ। কোথাও কোথাও আমন ধানের ক্ষেত বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে সোমবার ভোররাত থেকেও জেলাজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। রোববার সন্ধ্যায় শহরের অদূরে বিনেরপোতা এলাকায় বেতনা নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্রবল বেগে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। ফলে তালা উপজেলার ত্রিশ মাইল এলাকায় রাস্তা উপচে পানি ঢুকছে নগরঘাটা ইউনিয়নে। এসময় রাস্তার উপরে জাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে স্থানীয়দের।
অপরদিকে বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতিবৃষ্টির কারণে খাল-বিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সদ্য রোপণ করা আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। বৃষ্টির পরিমাণ আরও বাড়লে ধানের ক্ষেত টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন কৃষকেরা।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ২১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকাল থেকে আবহাওয়া স্বাভাবিক হতে পারে।
সাতক্ষীরা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টির কারণে সাতক্ষীরা শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় শত শত হেক্টর জমির ঘের, ফসলের ক্ষেতসহ জলাভূমি ডুবে গেছে। সুলতানপুর কাজীপাড়া কাজী সাঈদুর রহমান বলেন, বাড়িসহ সড়ক তলিয়ে গেছে।
বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলে মারাত্মক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অবস্থা এমন যে, চলাচল করতে গিয়ে মানুষ দুর্ঘটনায় পড়ছেন। বিনেরপোতা এলাকার মফিজুল ইসলাম বলেন, বিনেরপোতা শ্মশানঘাটের কাছে বেতনা নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। তালা উপজেলার ত্রিশ মাইল এলাকায় রাস্তা উপচে পানি ঢুকছে নগরঘাটা ইউনিয়নে। পানিতে বিনেরপোতা, গোপীনাথপুর, মাগুরা, খেজুরডাঙ্গা ও তালতলা এলাকার নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। অনেকের বাড়িঘরে পানি উঠেছে। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। রাস্তাও পানিতে ডুবে আছে। মাছের ঘের, ফসলের মাঠ ও পুকুর পানিতে একাকার হয়ে গেছে।
শহরের পুরাতন সাতক্ষীরার মিজানুর রহমান বলেন, এলাকায় পানি নিষ্কাশনের কোনো পথ নেই। রাস্তা ঘাট ঘর বাড়ীতে পানি উঠেছে । প্রতিবছরই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। অথচ দেখার কেউ নেই। পৌরসভার ড্রেন দিয়ে পানি না সরে উল্টো বেতনা নদীর পানি এলাকায় আসছে। ফলে জলাবদ্ধতা বাড়ছে।
সাতক্ষীরার রাজনীতি ব্যক্তিত্ব সমাজকর্মী শেখ নুরুল হুদা বলেন, সাতক্ষীরা শহর ও তার আশপাশের প্রায় অর্ধেক এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। বিশেষ করে কামালনগর, পুরাতন সাতক্ষীরা, সুলতানপুর, মুনজিৎপুর, বদ্দিপুর কলোনি, ঘুড্ডিরডাঙি, রসুলপুর, পলাশপোল, ইটাগাছা, কুখরালিসহ শহরের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এমনিতেই মাসের পর মাস এসব এলাকা পানিতে ডুবে ছিল। এরপর ভাদ্র মাসের বৃষ্টি এসব এলাকার মানুষকে চরম দুর্ভোগে ফেলেছে। শ্রমজীবী মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে। রোজগার করতে না পারায় অনেকের চুলো পর্যন্ত জ্বলছে না। পানি নিষ্কাশনে এখনও কোন উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ফলে নতুন নতুন এলাকায় পানি উঠছে।
এদিকে টানা চারদিনের প্রবল বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে তালা উপজেলার প্রত্যান্ত অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রাম। এসব গ্রামের ফলে শত শত মৎস্য ঘের, ফসলী জমি ও বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও খেলার মাঠ। গ্রামের মধ্যে পানি উঠায় সকল নলকুপ তলিয়ে যাওয়ায় পানীয় জলের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার মানুষ বাড়ি ঘর ছেড়ে গবাদি পশু নিয়ে রাস্তার উপর খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে গবাদি পশু নিয়ে নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেছেন।
সোমবার সকাল থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহ আল আমিন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওবায়দুল হক উপজেলার নগরঘাটা, তালা সদর সহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে পানি সরানোর উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেছেন। নিজে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন খাস খাল দখলমুক্ত করে পানি নামানোর ব্যবস্থা করছেন।
জালালপুর ইউপি চেয়ারম্যান এম মফিদুল হক লিটু জানান, তার ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এলাকার অধিকাংশ ঘের ও ফসলি জমি ভেসে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ মন্দির এমনকি মানুষের বাড়িঘরে পানিতে তলিয়ে গেছে।
তালা উপজেলা পানি কমিটির সাধারন সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান জানান, উপজেলার টিআরএম কার্যকর থাকলে এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না। অপরিকল্পিত নদী খনন, সংযোগ খাল উন্মুক্ত না থাকা এই উপজেলায় জলাবদ্ধতার মূল কারণ। এখনই যদি পদক্ষেপ না নেয়া হয় তাহলে তালা সহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সকল উপজেলা পানির নীচে তলিয়ে যাবে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য বিভাগের সব শেষ তথ্যানুযায়ী জানা গেছে –অতিবৃষ্টিতে ভেসে গেছে পাঁচ হাজারের বেশি মৎস্য ঘের ও তিন হাজারের বেশি পুকুর। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। এদিকে জোয়ারে নদীতে বেড়েছে পানির উচ্চতা। এতে শ্যামনগর ও আশাশুনির এলাকায় আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলের মানুষ।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
শুক্রবার সকাল থেকে সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ২১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলতি বছরে এ জেলায় সব থেকে বেশি বৃষ্টিপাত।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, যেসব এলাকায় জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা নেই টানা বৃষ্টির কারণে সেসব এলাকায় দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু বাঁধ সামন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বড় ধরণের ক্ষতির কোন শঙ্কা নেই।
এমআই