জসীমউদ্দীন ইতি, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি:
লেখাপড়া শেষে বয়োজ্যেষ্ঠ মা–বাবার দায়িত্ব নেওয়ার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে বেড়ে ওঠা লিটন এখন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। মাথায় ১৫টি এবং পুরো শরীরে আরও সাড়ে চার শতাধিক গুলি। এই যন্ত্রণায় কত দিন থাকতে হবে তা–ও তিনি জানেন না। তবে উন্নত চিকিৎসায় শরীর থেকে গুলিগুলো বের করা সম্ভব হলে তিনি স্বাভাবিক হবেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
এদিকে বৃদ্ধ বাবার পক্ষে কোনো রকমে প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো করানো সম্ভব হলেও উন্নত চিকিৎসার অর্থ জোগাড়ে অপারগ তিনি। নিজেকে এখন অসহায় ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছেন না লিটন (১৯)।
ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিশেষজ্ঞ শিহাব মাহমুদ শাহরিয়ার লিটনের চিকিৎসা করেছেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ছররা গুলিতে যদি খুব অসুবিধা না হয়, তাহলে এসব বের করতে আমি নিরুৎসাহিত করি। কারণ, ওর মাথায় যে ১৫টি গুলি আছে, সে জন্য ১৫ বার অস্ত্রোপচার করতে হবে। এতে রোগীর আরও জটিল অবস্থা তৈরি হবে। এ ছাড়া গুলিগুলো খুবই ছোট, কেটে সঙ্গে সঙ্গে বের করা যাবে—এমনটিও না।’
পৌর শহরের দক্ষিণ সালান্দর পাড়ার মিলননগর মহল্লায় লিটনের বাড়ি। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। গত ৪ আগস্ট ঠাকুরগাঁও শহরের কোর্ট চত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন লিটন।
ইয়াকুব আলী স্যানিটারি স্ল্যাব বানিয়ে বিক্রি করে সংসার চালান। অভাবের সংসারে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে লিটনও খণ্ডকালীন চাকরি করতেন একটি ওষুধ ফার্মেসিতে। সে চাকরিও এখন নেই।
আজ শুক্রবার লিটনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে-বসে কাতরাচ্ছেন লিটন। তাঁর পাশে হতাশা নিয়ে বসে আছেন মা-বাবা। সন্তান সুস্থ হতে পারবে কি না, এ নিয়ে চিন্তিত তাঁরা। মা লিলি বেগমের কপালে চিন্তার ভাঁজ আর চোখে পানি।
আজকের পত্রিকাকর কাছে লিটন সেই দিনের ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে জানান, ছাত্র আন্দোলনে ডাকা সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ৪ আগস্ট দুপুরে শহরের কোর্ট চত্বরের পূর্ব পাশের গলিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অবস্থান নেয়। এ সময় পুলিশ তাদের গুলি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে বলে। কিন্তু তাঁরা চলে যাওয়া শুরু করলে তাঁদের দিকে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এ সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। কিছু সময়ের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরে জ্ঞান ফেরার পর উঠে দাঁড়ালে তাঁর খুব কাছে থেকে আবারও এলোপাতাড়ি ছররা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীর গুলিবিদ্ধ হন। একপর্যায়ে কোনো রকমে হামাগুড়ি দিয়ে পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। ওই বাড়ির লোকজন লিটনের রক্তঝরা মাথায় কাপড় দিয়ে বেঁধে দেন।
একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাঁকেসহ গুলিবিদ্ধ অন্যদের ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে শহরের একটি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করে ১২টি গুলি তাঁর শরীর থেকে বের করা হয়।
এর এক দিন পর (৬ আগস্ট) রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর রংপুর সিএমএইচ হাসপাতালে দুই সপ্তাহ ভর্তি ছিলেন। সেখানেও অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু শরীর থেকে একটি গুলিও বের করা সম্ভব হয়নি। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে এখন তিনি বাড়িতেই রয়েছেন।
ব্যথায় কাতর লিটন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গুলি লাগার পরে শরীরের প্রত্যেকটা জায়গা যেন অবশ হয়ে আছে। একা কোনো কাজ করতে পারি না। অন্য কারও সহযোগিতা নিয়ে করতে হয়। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারি না, বসেও থাকতে পারি না। আবার গরম লাগলে ব্যথার তীব্রতা হয়। সারাক্ষণ বাতাসে না হয় ঠান্ডা জায়গায় থাকতে হয়। রাতে ঘুমাতে গেলে মাথায় বিঁধে থাকা গুলির যন্ত্রণায় ঘুমও হয় না। বালিশে মাথায় দিতেও কষ্ট হয়। খুব অসহায় বোধ হয়।
লিটন বলেন, ‘এখন সরকারের কাছে একটি চাওয়া—আমার শরীর থেকে গুলিগুলো বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা যেন করা হয়। আবার আমি স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে চাই। এই দেশের জন্য, আমার পরিবারের জন্য কাজ করতে চাই।
লিটনের বাবা ইয়াকুব আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘টানাটানির সংসারে ধারদেনা করে ছেলের জন্য ওষুধ কিনতে হচ্ছে। বড় স্বপ্ন ছিল ছেলেটা পড়ালেখা শেষ করে একদিন সংসারের হাল ধরবে। পরিবারের অভাব দূর হবে। কিন্তু আমাদের সাজানো স্বপ্ন এখন শেষ হয়ে গেল!’
সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতদের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল উইংয়ের দায়িত্বরত সদস্য রাকিব ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা খোঁজখবর রাখছি। উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে লিটনের শরীরের গুলিগুলো বের করে দেওয়া সম্ভব হলে, দ্রুত সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে এই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ। যা জোগাড় করা তাঁর দরিদ্র পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের কাছে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাই।
সময় জার্নাল/এলআর