মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ইনফিনিটি সিক্যুয়েল:ডিম আগে না মুরগি আগে

রোববার, নভেম্বর ১০, ২০২৪
ইনফিনিটি সিক্যুয়েল:ডিম আগে না মুরগি আগে

প্রযুক্তি ডেস্কঃ

‘ডিম আগে না মুরগি আগে?’ প্রশ্নটি ছিল মহাবিশ্ব, সময় এবং পদার্থবিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে আজকের বড় প্রশ্নগুলোর প্রাথমিক সংস্করণের মতো। তারপর উনিশ শতকের জীববিজ্ঞানী ও ভূতত্ত্ববিদরা প্রমাণের ভিত্তিতে এ প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দিতে শুরু করেছিলেন।

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা অনেকবার চেষ্টা করেছেন। এবার হয়তো এর সমাধান খুঁজে পেয়েছেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাঁদের গবেষণা বলছে, ডিমের মতো প্রাকৃতিক গঠন মুরগির বহু আগেই পৃথিবীতে ছিল।

গবেষণাটি চালানো হয়েছে এককোষী একটি প্রাচীন জীব ক্রোমোসফেরা পারকিনস্কি-কে নিয়ে, যা ২০১৭ সালে হাওয়াইয়ের সমুদ্রতল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল। গবেষকেরা বলছেন, ১০০ কোটি বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে থাকা এই জীব এমন কিছু কোষ তৈরি করতে পারে, যা ডিম বা ভ্রূণের মতো কাজ করে। এ থেকে বোঝা যায়, প্রকৃতিতে ডিম তৈরির পদ্ধতি প্রাণীর উদ্ভবের আগে থেকেই ছিল।

গবেষণাপত্রের সহলেখক ওমায়া দুদিন বলেন, যদিও এটি এককোষী জীব, তবে এটি প্রাণীর মতো গঠন তৈরিতে সক্ষম। আরেক গবেষক মারিন অলিভেটার মতে, ‘এই আবিষ্কার পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণা সমৃদ্ধ করছে। 

এরকম একটি পুরোনো ও জনপ্রিয় প্যারাডক্স মূলত মানব মস্তিষ্কের একটি জটিল প্রক্রিয়াকে তুলে ধরে যেখানে মানুষ সবসময়েই একটি ঘটনার ওপর নির্ভরশীল আরেকটি ঘটনার প্রবাহকে ঠিক করে সাজাতে গিয়ে জটিলতা অনুভব করে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী এরিস্টটল এ ধরনের জটিলতাকে ইনফিনিটি সিক্যুয়েলের (অসীম ধারা) একটি চমৎকার উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন যার কোন সঠিক সূচনা নেই। এরিস্টটলের কাছে কীভাবে ইনফিনিটি কাজ করে তা ভাবার একটি উপায় ছিল এটি।

পরবর্তীতে গ্রিক ইতিহাসবিদ ও আত্মজীবনী লেখক প্লুটার্ক ডিম এবং মুরগির জটিলতাকে একটি 'কঠিন ও গুরুতর সমস্যা' বলে অভিহিত করেছিলেন। তার মতে, এটি দার্শনিকদের পৃথিবীর কোনো শুরু আছে কিনা বা সেটি কখনো শেষ হবে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছিল।

যদি আপনাদের মনে হয় ডিম মূলত খোসা সদৃশ একটি বস্তু যেটিকে চামচ দিয়ে ছাড়ানো যায় তাহলে ডিম অবশ্যই মুরগির অনেক আগেই এসেছে। কারণ সব পাখিই ডিম পাড়ে এবং লক্ষ লক্ষ বছর আগে এরা পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষা ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, মুরগি পৃথিবীতে এসেছে ১০ হাজার বছর বা তার কিছু সময় আগে। সুতরাং, মুরগি এবং ডিম এর মধ্যে ডিম প্রথমে এসেছিল। প্রকৃতপক্ষে খোসাযুক্ত ডিমগুলো প্রায় ১৬০ মিলিয়ন বছর আগে আধুনিক পাখিদের পূর্বপুরুষ সহ নির্দিষ্ট ডাইনোসর গোষ্ঠীতে বিবর্তিত হয়েছিল। অন্যান্য কিছু ডাইনোসর গোষ্ঠী যেমন সরোপডের ডিম প্রায় ১৯৫ মিলিয়ন বছর আগেই খোসাযুক্ত ছিল। তাই বলাই যায়, প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর বয়সী ডিম মুরগির আগেই পৃথিবীতে এসেছে যেহেতু মুরগির বয়স মাত্র ১০ হাজার বছর।

কিন্তু এ ধরনের যুক্তিতে সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। কারণ সব প্রাণীর ডিম একরকম হয় না, এমনকি প্রজাতিভেদে পাখির ডিমের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ডিমের ভিন্নতার মূল কারণ হল ডিম্বাশয়। প্রাণীভেদে ডিম্বাশয়ের ভিন্ন গঠনের জন্যই আমরা ভিন্ন ধরনের ডিম দেখতে পাই। মুরগির ডিম্বাশয়ের গঠন ও কাজ সত্যিকার অর্থে একটি চমকপ্রদ বিষয়।

আপনার রান্নাঘরে পৌঁছানোর আগে মুরগির প্রতিটি ডিমকে একটি অসাধারণ যাত্রার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রথমে মুরগির ডিম্বাশয়ে ডিমের আবরণটি খোসা ছাড়া একটি পিচ্ছিল গোলকসদৃশ অবস্থায় থাকে। ডিম্বাশয়ের ভেতরে থাকা কিছু বিশেষ ছিদ্র থাকে যা থেকে সেগুলোতে রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো হয়। রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে ক্যালসিয়াম অন্যতম। এর ফলে ডিমটির ওপরে ক্যালসিয়ামের একটি আস্তরণ পড়ে যার জন্য ডিমের ওপর শক্ত খোসার সৃষ্টি হয়। ভিন্ন ভিন্ন পাখির ডিম্বাশয় থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থের ওপর ভিত্তি করে ডিমের আকৃতি, খোসার রং এবং খোসার পুরুত্বের ভিন্নতা দেখা দেয়।

তাহলে আমরা আমাদের প্রশ্নটিকে আরেকটু পরিমার্জিত করে জিজ্ঞাসা করতে পারি, ডিম আগে না ডিম্বাশয় আগে? যদি ডিম না থাকত তাহলে ডিম্বাশয়ের আসলে কি কাজ ছিল? আমরা যদি আরো গভীরে যাই তাহলে দেখতে পাবো, ডিম্বাশয় বিবর্তিত হওয়ার অনেক আগেই ডিম এসেছে। বিভিন্ন জীবাশ্মের (ফসিল) রেকর্ড দেখে বলা যায়, সময়টা কয়েক লাখ বছর বার তার থেকেও বেশি হতে পারে।

অবিশ্বাস্যভাবে ডিম অনেক প্রাচীন, ৬০০ মিলিয়ন বছর বা তারও বেশি সময় আগের। আমরা প্রাচীন সমুদ্রের তলগুলোতে গোলকের মতো নমুনা দেখতে পেয়েছি যেগুলোর আকৃতি মাত্র এক মিলিমিটারের মতো এবং ভালোভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় ছিল। কয়েকটি নমুনার মধ্যে আদিম কোষ ছিল বলে যুক্তি দেয়া হয়েছে। আদিম কোষগুলো দুই, চার, আট, ষোল ক্রমধারায় বিভাজিত হয়ে সেখান থেকে একটি ভ্রূণে রূপান্তরিত হয়ে তা থেকে একটি বাচ্চার জন্ম দিয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার করার সক্ষমতা রাখে।

আমরা এখন এই প্রাচীন ডিমগুলো থেকে আগত প্রাণী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ধারণা করা হয়, প্রাণীগুলো জেলিফিশ বা আদিম সামুদ্রিক পতঙ্গ হতে পারে। এই জীবাশ্ম ডিমগুলো মুরগি এবং ডিম্বাশয় থেকে অনেক বেশি পুরোনো। জীবাশ্মগুলো এডিকারান যুগের, প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর আগের। পালক, কঙ্কাল, চোখ এবং ঠোঁট সহ একটি মুরগির অস্তিত্ব তখনকার সময়ে জীবিত যে কোন প্রাণীর কথা ভাবলে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় ছিল। তবুও সম্ভবত এ সময়ের আগেও পৃথিবীতে ডিমের অস্তিত্ব ছিল।

যদি আমরা ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মতো যৌন কোষ বিবেচনা করি তাহলে ডিম মুরগির প্রায় ১ বিলিয়ন বছর আগেই পৃথিবীতে এসেছে। শৈবাল, গাছ এবং প্রাণী (অধিকাংশ সময়ে এককোষী জীব) সহ আধুনিক যুগের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রাণীর যৌন প্রজননের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, ডিম এবং শুক্রাণু সম্ভবত প্রায় ১ বিলিয়ন বছর আগে বিবর্তিত হয়েছিল। অর্থাৎ আজকে আমরা যে প্রাণীগুলোকে চিনি সেগুলো বিবর্তিত হওয়ার অনেক আগেই ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর অস্তিত্ব ছিল, এমনকি ডিম্বাশয়েরও বহু বছর আগে।

তাই এ শতাব্দীর সবচেয়ে বিখ্যাত প্যারাডক্সের উত্তর হলো, ডিম আগে। ডিম বয়সে মুরগির থেকেও বড়। তাই কেউ যখন আমাকে প্রশ্নটি আবার করবে তখন আমি ডিমের কথাই বলবো। 

যখন আমরা জেনেটিক্স এর কথা বিবেচনা করি তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আছে যেখানে মুরগির পূর্বপুরুষ 'বন্য ফাউল' একটি নিষিক্ত ডিম পেড়েছিল। সেই ডিমের মধ্যেই সঠিক মিউটেশনের মধ্য দিয়েই সেটি পরবর্তীতে 'মুরগি' হিসেবে বিবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু একটি 'মুরগি' আসলে কি? এটা কি বাড়ির উঠানে ঘুরে বেরানো ঐতিহ্যবাহী পাখি, নাকি পোল্ট্রি শিল্প দ্বারা প্রজনন করা আধুনিক ব্রয়লার? শতাব্দী ধরে 'মুরগি' ধারণাটি জিন ও জেনেটিক বিবর্তনের একটি প্রবাহিত নদী যা প্রাকৃতিক শক্তি অথবা মানুষের হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। 'মুরগি' নিয়ে ধারণা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান কারণ মানুষ প্রাণীকে শ্রেণিবদ্ধ করতে পছন্দ করে।

মুরগি নাকি ডিম? ডিম নাকি ডিম্বাশয়? ডিম নাকি প্রাণী? এই প্রাচীন প্যারাডক্স যা নিয়ে ২ হাজার বছর আগেও চিন্তা করা হয়েছিল, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ এখনো কমেনি। বিজ্ঞানের এরকম উন্নতির যুগে এসেও প্রশ্নটি আমাদের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি করে। ডিম যেটি থেকে প্রতিটি আধুনিক প্রাণীর জীবনের শুরু, সত্যিই অসাধারণ সৃষ্টি।

তানহা আজমী


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল