বিশেষ প্রতিবেদক:
নোয়াখালীকে আলাদা বিভাগ এবং নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলাকে বিভাজন করে নতুন উপজেলা গঠন ও দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া কেন্দ্রিক নতুন জেলাগঠনের দাবি দীর্ঘদিনের।
এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টিকটকে ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’ মিমের (হাস্যরসাত্মক ছবি, ভিডিও) ছড়াছড়ি। এই মিমের জনপ্রিয়তা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়েছিল। বেশ কিছু বিদেশি টিকটকারকে দেখা গেছে ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’ মিম প্রচার করতে। তাদের মধ্যে কানাডার টিকটকার বোরজাহ ইয়াংকির টিকটকটি ভাইরাল হয়েছিল। ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’ নামের একটি নাটকও তৈরি হয়েছে। বিভাগের দাবি নিয়ে ট্রল বা মিমের উদ্দেশ্য যে নির্মল হাস্যরস, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। তবে বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী, নোয়াখালী জেলা হিসেবে তেমন ছোট নয়। বরং দিন দিন এর আয়তন বাড়ছেই।
বাংলাদেশের প্রাচীন জেলার মধ্যে নোয়াখালী অন্যতম। ১৮২১ সালে এই জেলার সৃষ্টি। এখানে জন্মেছেন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন, সাবেক স্পিকার মালেক উকিলসহ অসংখ্য গুণী মানুষ। রয়েছে আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য। জেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে গড়ে উঠছে বাংলাদেশের মতো আরেকটি ভূখন্ড। তাই সবদিক বিবেচনা করে যেন প্রাচীন এই জেলাকে নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ নোয়াখালীকে দশম প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে বাস্তবায়ন করার জন্য আন্দোলনরতরা জোড় দাবি জানিয়ে আসছে।
জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৮২১ সালে নোয়াখালী জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নোয়াখালী নামকরণ করা হয়। নতুন নতুন বাড়িঘর, শিল্পকলকারখানা স্থাপনসহ নানা কারণে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে বেশির ভাগ জেলার কৃষিজমি দিন দিন কমলেও একমাত্র নোয়াখালী জেলা জেলায় কৃষি জমির পরিমাণ বেড়ে চলেছে। সরকারি কাগজপত্রে নোয়াখালীর আয়তন ৪ হাজার ২০২ বর্গকিলোমিটার বলা হলেও বাস্তবে এর আয়তন আরও বেশি বলে মনে করেন গবেষক ও ভূতত্ত্ববিদেরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত জরিপও বলছে, নোয়াখালীর আয়তন বাড়ছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিবিএসের জেলা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩১ বছরে জেলার আয়তন বেড়েছে ৮৫ বর্গকিলোমিটার। তবে নোয়াখালীর উপকূলে নতুন জেগে ওঠা চরের হিসাব এই জরিপে নেই। সেসব যোগ করলে নোয়াখালীর আয়তন আরও অনেক বাড়বে নিশ্চিতভাবেই।
সরকারের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং, বন বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমুদ্রে জেগে ওঠা নতুন ভূমি নিয়ে নানা কর্মসূচি পরিচালনা করছে। জানা গেছে, গত ১০০ বছরে নোয়াখালীর উপকূলের নিঝুম দ্বীপ, নলেরচর, কেয়ারিংচর, ভাসানচরসহ অনেক দ্বীপ জেগে উঠেছে। ভাসানচরের দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে জেগেছে ১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের গাঙ্গুরিয়ার চর। এখানে চাষাবাদও শুরু হচ্ছে। হাতিয়ার পশ্চিমে নতুন করে জেগে উঠেছে ঢালচর, চর মোহাম্মদ আলী, চর ইউনুস, চর আউয়াল, মৌলভির চর, তমরুদ্দির চর, জাগলার চর, ইসলামচর, নঙ্গলিয়ার চর, সাহেব আলীর চর ও দক্ষিণে কালামচর।
জানতে চাইলে নোয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু ইউছুফ বলেন, নোয়াখালীর দক্ষিণে নতুন অনেক চর জাগছে। তবে নতুন করে জেগে ওঠা সব কটি চর স্থায়ী না-ও হতে পারে। তবে ঠিক কী পরিমাণ নতুন চর জাগছে, সে রকম কোনো জরিপকাজ সাম্প্রতিক সময়ে হয়নি। এ বছর ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে কিছু ডুবোচর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই চরগুলো আগামী শুষ্ক মৌসুমে পলি জমে পুনরায় জেগে উঠতে পারে। বন বিভাগ সাধারণত যেসব চর জাগতে জাগতে ঘাস জন্ম নেয়, সেগুলোকে বনায়নের আওতায় নিয়ে থাকে।
নোয়াখালীর উপকূলে মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে জেগে ওঠা নতুন ভূমি এখনো স্থায়ী নয় পুরোপুরি। এসব ভূমির একাংশ এখনো জোয়ার–ভাটায় তলিয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিও রয়েছে সেসব দ্বীপে। তবে সরকারের হাতে নেওয়া বনায়নসহ নানা কর্মসূচি চলছে এসব দ্বীপ ঘিরে। আগামী এক দশকে এসব নতুন ভূমি নোয়াখালীর আয়তন আরও বাড়াবে।
সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপ-সংলগ্ন পালকির চরে গিয়ে দেখা যায়, চরটির দক্ষিণে যত দূর চোখ যায়, তার সবটাই নতুন জেগে ওঠা চর। নিঝুম দ্বীপের আশপাশের মেঘনা ও বঙ্গোপসাগর মোহনায় দূর থেকে চোখে পড়ে সবুজে ঘেরা বিভিন্ন চর। চরের বাসিন্দাদের মতে, নতুন জেগে ওঠা এসব চরের কারণে নোয়াখালীর আয়তন বেড়েই চলছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, নোয়াখালী দক্ষিণে জেগে ওঠা চরগুলোকে নিয়ে সরকার পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করা গেলে এখানে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হবে। আর তাতে প্রাচীন এ জেলা পর্যটন ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে উন্নতির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
নোয়াখালীর রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে নোয়াখালী জেলার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ আসে এই জেলার প্রবাসী বাসিন্দাদের মাধ্যমে। একইভাবে এ অঞ্চলের কৃষিও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নতুন ভূমি জেগে ওঠার পর পুরোপুরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে নতুন করে গুরুত্ব পাবে নোয়াখালী।
তানহা আজমী