শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বিশ্বের সবচেয়ে শীতল গ্রামে জীবন যেমন

বুধবার, নভেম্বর ২৭, ২০২৪
বিশ্বের সবচেয়ে শীতল গ্রামে জীবন যেমন

ফিচার ডেস্ক:

সাইবেরিয়ান সাখা প্রজাতন্ত্র। বিশ্বের সবচেয়ে শীতল অঞ্চলগুলোর একটি। ফটোসাংবাদিক নাতালিয়া সাপ্রুনোভা দুমাস কাটিয়েছেন এখানে। তার ক্যামেরায় উঠে এসেছে এখানকার মানুষের জীবন।

উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ার ওয়মিয়াকন। স্থায়ী মানববসতি আছে, এমন জায়গাগুলোর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে শীতল স্থান।  গ্রামটি রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের সাখা প্রজাতন্ত্রে ইন্দিগিরকা নদীর বাম তীরে 'পোল অভ কোল্ড' অঞ্চলে অবস্থিত। 
শীতের দেবতা চিসখানের গুহায় প্রবেশ করছেন একজন ইয়াকুত নারী। চিসখান ইয়াকুত লোককথার চরিত্র। এই গুহাটি একটি জাদুঘর—এখানে ভাস্কররা বরফের ভাস্কর্য তৈরি করেন।
শীতের দেবতা চিসখানের গুহায় প্রবেশ করছেন একজন ইয়াকুত নারী। চিসখান ইয়াকুত লোককথার চরিত্র। এই গুহাটি একটি জাদুঘর—এখানে ভাস্কররা বরফের ভাস্কর্য তৈরি করেন। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা

খারা-তুমুল, বেরেগ-ইউরদিয়া, টমটর, ইউচ্যুগেই ও এয়ারোপোর্ট-সহ অন্যান্য গ্রামীণ এলাকার সঙ্গে যুক্ত ওয়মিয়াকন। এয়ারোপোর্ট নামটি স্থানীয় বিমানবন্দর থেকে নেওয়া হয়েছে। 

ওয়মিয়াকন মালভূমিতে অবস্থিত। গ্রামটির জনসংখ্যা প্রায় ২ হাজার। মালভূমিটি একটি বড় বাটি আকৃতির নিম্নভূমির মধ্যে অবস্থিত, যা ওয়মিয়াকন ডিপ্রেশন নামে পরিচিত। 

এ অঞ্চলে শুষ্ক, আংশিক মেঘলা ও তীব্র শীতল জলবায়ু বিরাজ করে। ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে টোমতর-এর একটি আবহাওয়া স্টেশনে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল মাইনাস (–) ৬৭.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ১৯৯১ সালে গ্রিনল্যান্ডে রেকর্ড করা মাইনাস (–) ৬৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে সামান্য উষ্ণ।
গোয়ালখানায় ঢুকছে একটি গরু। ইয়াকুত গরু বরফজমা আবহাওয়ায় দীর্ঘক্ষণ বাইরে থাকতে পারলেও বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিচে নেমে গেলে এ প্রাণীটিকে উষ্ণ পরিবেশে থাকতে হয়।
ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা

অক্টোবরের শুরুতে সাখা বা ইয়াকুতিয়া অঞ্চলে একটি অ্যান্টিসাইক্লোন গঠিত হতে শুরু করে। এর ফলে বায়ুচাপ বেড়ে যায়। শুরু হয় মেরু নিশি বা পোলার নাইট। এ সময় পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ দ্রুত শীতল হয়। 

ইউরোপের জলবায়ুর জন্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে ওয়মিয়াকন। আবহাওয়া স্টেশনগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকে এ জায়গা। 
বার্নের ভেতরে একটি ইয়াকুত গরুকে খাওয়াচ্ছেন ৬৩ বছর বয়সি ইভদাকিয়া। তাপমাত্রা এখানে মাইনাস ১০ থেকে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। ওয়মিয়াকনের 'নির্দিষ্ট ভূ-জলবায়ুগত মর্যাদার' স্বীকৃতি নেই বলে এখানকার কৃষকরা তাদের খামারের উন্নয়নের জন্য কোনো আর্থিক সহায়তা পায় না। ইভদাকিয়ার ৪৭টি গরু আছে। তার মাসিক আয় ১৫০ ইউরো। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
ইভদাকিয়ার কোলে সদ্যোজাত একটি বাছুর। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
বছরের এ সময় সদ্যোজাত বাছুরকে নিজ হাতে খাওয়ান ইভদোকিয়া। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
৭৫ বছর বয়সি গালিয়া উৎসাহী ক্রীড়াবিদ। প্রতি বছরই ৩৫ কিলোমিটার রেসে অংশ নেন। তার বাড়ি ওয়মিয়াকন বিদ্যুৎকেন্দ্রের হিটিং নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত নয়; তাই কাঠ জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখতে হয়। শীত থেকে বাঁচতে বল্গা হরিণের পায়ের নিচের অংশের চামড়া তৈরি বানানো বুট পায়ে দেন। ওয়মিয়াকন, বেরেগ-ইয়ুরদিয়া ও খারা-তুমুলে বাড়ির সংখ্যা ৩০৫; এর মধ্যে ১২০টির বেশি বাড়ি গরম রাখা হয় কাঠ পুড়িয়ে। সবচেয়ে ঠান্ডা মাসগুলোতে বাড়িপ্রতি ১০০ ঘনমিটার লার্চ গাছ পোড়ানো হয়। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
সাহিত্য ও স্থানীয় পাঠের জাদুঘরে সোভিয়েত আমলে ওয়মিয়াকনে বাধ্যতামূলক শ্রমশিবিরে আটক রাখা বহু কবি-সাহিত্যিকের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
ভ্যালেরি ভিনোকুরভ (৬৫) গত দুই দশক কাটিয়েছেন ওয়মিয়াকনের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ ও নথিবদ্ধ করে। তার পর্যবেক্ষণ বলছে, এ অঞ্চল দিন দিন উষ্ণ হচ্ছে। ওয়মিয়াকনের আগে গরমে স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকত ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এবার তা ছিল রেকর্ড ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর শীতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস ৬৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেড়ে মাইনাস ৫৪ ডিগ্রি হয়েছে। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
কোলিমা মহাসড়কে—যার ডাকনাম 'হাড়ের সড়ক'—হাঁটছেন এক ব্যক্তি। গুলাগে বন্দি রাজনৈতিক বন্দিদের দিয়ে ১৯৩০-এর দশকে মহাসড়কটি নির্মাণ করানো হয়। মহাসড়কটি বন্দরনগরী ম্যাগাদানকে নিঝনি বেস্তিয়াখ শহরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ১,২১৯ মাইল দীর্ঘ এই মহাসড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে প্রাণ গেছে আড়াই লাখ থেকে ১০ লাখ মানুষের। তাদের বেশিরভাগের কবরই হয়েছে সড়কের পাশে অথবা সরাসরি সড়কের নিচে। আধুনিক সরঞ্জামাদি থাকার পরও প্রকল্পটি ভীষণ কঠিন হওয়ায় এ মহাসড়কের কাজ এখনও শেষ করা হয়নি। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
ওয়মিয়াকনের জন্য কয়লা নিয়ে যাওয়ার পথে বিকল হয়ে গেছে একটি ট্রাক। শীতের সময় বাইরে রাখলে গাড়ি কখনও বন্ধ করা হয় না। বন্ধ রাখলেই গাড়ি বরফে জমে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু রাখলেও ট্রাকের চাকা জমে শক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনটা ঘটলে গ্রীষ্মের আগে আর সেই ট্রাক জায়গা থেকে নড়ানো যায় না। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
ওয়মিয়াকনের সবচেয়ে নিকটবর্তী পেট্রোল স্টেশনটিও ২৫ মাইল দূরে, টমটরের কাছে। মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রায় ঠান্ডার কারণে কম্বাশ্চন প্রক্রিয়ায় ভীষণ চাপ পড়ে বলে গাড়ির ইঞ্জিন দ্বিগুণ তেল খায়। রাতের বেলায় গাড়ি রাখা হয় গরম গ্যারেজে; তারপরও সেগুলো চালু হতে অনেকক্ষণ লেগে যায়। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
ওয়মিয়াকন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রসায়নের ক্লাস করছে। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
ওয়মিয়াকনের একমাত্র বিদ্যালয়ে গণিত ক্লাস করছে চৌদ্দ বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয়টি নির্মাণের জন্য টাকা দিয়েছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী নিকোলাই ক্রিভোশাপকিন; তার নামেই নামকরণ হয়েছে পাঠশালাটির। ক্রিভোশাপকিন ইয়াকুতিয়ার বাসিন্দাদের বহুবার সাহায্য করেছেন। এ বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী মাত্র ১০৭ জন; তাই শ্রেণিকক্ষের আকারও খুব ছোট। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
ওয়মিয়াকনের বাসিন্দাদের ঘরের ভেতরে পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। টয়লেট বাড়ির বাইরে, কাঠের তৈরি কুটির। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
মাইনাস ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওয়মিয়াকন উপত্যকা পাড়ি দিচ্ছে একদল বল্গা হরিণ। গন্তব্য ওসিকাম-এ আদিবাসী ইভেন গোত্রের বেজ ক্যাম্প। ওসিকাম ইভেনদের পালে ৩৫০টি বল্গা হরিণ রয়েছে। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
ওমিয়াকনীর ইন্দিগিরকা নদী দেখছেন ঠান্ডার দেবতা চিসখান। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা
মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টমটর স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন দুই নারী। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা

ভীষণ বৈরী পরিবেশে জীবনযাপন করে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা। বরফে জমে যাওয়া ভূমির বাসিন্দা এই মানুষগুলো মূলত গরু, ঘোড়া ও বল্গা হরিণ (রেইনডিয়ার) পালন; শিকার; মাছ ধরা, বনজ পণ্য সংগ্রহ ও কাঠ কাটার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। 

এখানকার আদিবাসী ইভেন সম্প্রদায় একসময় বল্গা হরিণ পালন করে যাযাবর জীবনযাপন করত। তবে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনা ভীষণ কঠিন মনে হওয়ায় সোভিয়েত সরকার এই সম্প্রদায়কে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখত। এ কারণে ১৯৩০-এর দশকে ইভেনদের এই অঞ্চলে স্থায়ী বসতি স্থাপনে এবং গবাদিপশুর খামার নির্মাণে বাধ্য করা হয়। 
পোর্টেবল সনা কেবিনে বসে বই পড়ছেন এক ব্যক্তি। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা

পরে গুলাগ ব্যবস্থার আওতায় ইন্দিগিরকা নদীর মোহনা থেকে এই অঞ্চলের ভেতর পর্যন্ত কয়েক ডজন শ্রমশিবির তৈরি করা হয়। এসব শ্রমশিবির গড়ার একটি উদ্দেশ্য ছিল কোলিমা মহাসড়ক নির্মাণ। 

অনেক বন্দি ও নির্বাসিত ব্যক্তি মুক্তি পাওয়ার পরও এ এলাকা ছেড়ে যেতে পারেননি। শেষে তারা এই অঞ্চলেই থেকে যান। 
খাবার তৈরি করছেন গরুর খামারি ইভদোকিয়া। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা

ওয়মিয়াকন গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয় ইতিহাসের একটি জাদুঘর আছে। অঞ্চলে কারাভোগ করা বা নির্বাসিত হওয়া লেখক, কবি, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে তৈরি হয়েছে এ জাদুঘর।
ওমিয়াকন আবহাওয়া স্টেশনে মাটির তাপমাত্রা মাপছেন নিনা বাকিরোভা। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা

এছাড়া স্ট্যালিনীয় নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে এখানে 'বেল অভ মেমোরি' নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভও রয়েছে। বর্তমানে কোলিমা মহাসড়ক দিয়ে পেট্রল ও কয়লা পরিবহন করা হয়। 

তীব্র ঠান্ডার কারণে ওয়মিয়াকনে কয়েক মাস বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। গ্রামটির প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩১ সালে। ১৯৫১ সালে এ স্কুল অত্র অঞ্চলের প্রথম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। 
টমটরের থার্মোমিটার বলছে তাপমাত্রা মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ছবি: নাতালিয়া সাপ্রুনোভা

ওয়মিয়াকনের সিংহভাগ বাড়িতে আংশিক সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম (ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা) থাকলেও বাড়ির ভেতরে কোনো পয়ঃনিষ্কাশন (স্যানিটেশন) ব্যবস্থা নেই। 

ওয়মিয়াকনের বাসিন্দাদের আশা, সাখা সরকারকে তাদেরকে বিশেষ ভূ-জলবায়ুগত মর্যাদা দেবে—যার সুবাদে তারা দৈনন্দিন জীবন ও পশুপালনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে আর্থিক সহায়তা পাবেন।

এমআই


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল