শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার ও বিনিয়োগ আকাঙ্ক্ষা

সোমবার, ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪
মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার ও বিনিয়োগ আকাঙ্ক্ষা

জামাল উদ্দীন:

নিত্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বে গের কমতি নেই জনমনে। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে বেশ প্রচেষ্টাও রয়েছে সরকারের। কিছু নীতিপদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে ফলপ্রসূ হচ্ছে বলে মনে হয় না। দেশে অধিকাংশ জনগণের আয়সীমার তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি। তাহলে আয় বাড়াতে হবে কিংবা মূল্যস্ফীতির কমাতে হবে। বিষয়টি বেশ জটিলও। রয়েছে বেকারত্বের চাপ। এ পরিস্থিতি কর্মসংস্থানমুখী বিনিয়োগ বাড়ানোর গুরুত্ব বহন করে। বেকারত্ব যে পরিমাণ বাড়ছে তাতে কর্মসংস্থানের দিকে জোর না দিলে দেশে সামাজিক অস্থিরতা তৈরির আশংকা থাকে। কর্মসংস্থান, বিনিয়োগবৃদ্ধি তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে এগুতে হলে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ, নীতিমালা দরকার। সুদের হার কমিয়ে এনে বিনিয়োগ  উৎসাহিত করার মাধ্যমে উদ্যেক্তাদের মাঝে আশা সঞ্চার করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার নীতি বহাল আছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে সংকোচনমূলক নীতিতেই ভরসা করেছেন নীতিনির্ধারকরা। যে লক্ষ্যে এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তার সাফল্য নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। 

এখন বিনিয়োগের জন্য যে পরিমাণ সহায়ক পরিবেশ দরকার বা যেসব নীতি সহায়তা দরকার তার সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। প্রথমে আসি ব্যাংক ঋণের সুদ হার নিয়ে। আমাদের এখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় উচ্চ সুদ হার বিনিয়োগে বড় বাধা। ব্যবসায়ীরা বরাবরই নমনীয় সুদের পক্ষে ছিলেন। এটা নিয়ে দীর্ঘ দিনের দাবি বিশেষত সিঙ্গেল ডিজিট সুদের হার বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি সিম্পল রেট বা সরল সুদ হার ব্যবস্থা প্রবর্তন । কিন্তু এই একটি জায়গায় আমরা ঠিক স্ট্যান্ড নিতে পারিনি। মাঝে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনা হলেও আবার তা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিগত সময়ে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটা না হলেও সরল সুদ হার প্রবর্তন করা যায়নি। এ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল এর সঙ্গে একাধিকবার কথাও বলেছি। তিনি দিনক্ষণ মাস ঠিক করে দিয়েও সরল  সুদ হার বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পরবর্তীতে সিঙ্গেল ডিজিটের বদলে আবার তা ডাবল ডিজিটে পৌঁছে যায়।

সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন-এমন কথা নতুন নয়। আগেই বলেছি, সুদের হার বৃদ্ধির বিষয়ে যুক্তি হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সামাল দেয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচন মূলক মুদ্রা নীতি অনুযায়ী দেশে যে হারে মূল্য স্ফীতি বেড়েছে তাতে এটি কমিয়ে আনার  অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে সুদের হার বাড়ানো কে ব্যবহার করা হয়েছে। এ কথা ঠিক যে সুদের হার বাড়ানোর ফলে মুদ্রা সরবরাহ কমে যাবে। কিন্তু এর আরো কিছু প্রভাব রয়েছে। আমরা যদি শুধু মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সুদের হার বাড়াই তা কিন্তু প্রকারান্তরে বিনিয়োগকে আবার নিরুৎসাহিত করে। কারণ সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগের খরচ তথা ব্যবসায়িক খরচ বেড়ে যায়। এমনিতেই বাংলাদেশে ব্যবসার খরচ অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুইং বিজনেসে ব্যবসার সহজীকরণের জন্য বিভিন্ন সময় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সুদের হার বৃদ্ধির ফলে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প খাত বিকশিত হচ্ছে না। 

দেশে  খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণও সুদে হার বৃদ্ধি। ব্যবসায়িক খরচ বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তা সময়মতো কিস্তি দিতে পারেন না। তখন তার নেয়া ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে। একদিন পুরো উদ্যোগটাই রুগ্ন হয়ে পড়ে, উদ্যোক্তার স্বপ্ন এবং কর্মসংস্থান-দুটোই নষ্ট হয়। এই ঋণের বোঝা  জাতির ঘাড়ে পড়ে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর বলেছেন আগামী দিনে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। খেলাপি  ঋণ বাড়ার পেছনে যদিও বিগত সরকারের সময়কার উদাহরণ টেনেছেন। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার পিছনে নানা অনিয়ম কাজ করেছে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং পরিদর্শন বিভাগ দীর্ঘদিন তাদের তদারকি কাজ বন্ধ রেখেছিল। কি কারনে, কার নির্দেশে রুটিন ব্যাংকিং ইনস্পেকশন বা সুপারবিশন যাই বলি না কেন- এটা বন্ধ ছিল সে বিষয়টি তদন্ত হওয়া দরকার। আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং পরিদর্শন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাদের কাজই হচ্ছে নিয়মিত ভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ইন্সপেকশন করা। এসব ইনস্পেকশনে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা বা কোন অনিয়ম থাকলে স্পষ্ট হয়ে উঠতো। ব‌্যাংকগুলোকে পরিদর্শন করার পর সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে উপর মহলে প্রতিবেদন পাঠানো হতো। অনেক সময় মিডিয়ার হাতে পড়ে গেলে সংবাদপত্র গুলোর মাধ্যমে পাঠকগণ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে পারতেন। তখন আমানতকারীরা আমানতের ক্ষেত্রে তথা ডিপোজিট রাখার ক্ষেত্রে বাছ-বিচার করার একটা সুযোগ পেতেন। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী অনেকেই ভালো ব্যাংকে আমানত রাখতেন। কিন্তু ব্যাংকিং পরিদর্শন বিভাগকে বসিয়ে রেখে গোটা ব্যাংক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয়ার চক্রান্ত করা হয়েছিল কাদের স্বার্থে- সে বিষয়েও মনোযোগ কাম্য। এমনও শোনা গেছে কতিপয় প্রভাবশালীর ইন্ধনে কিছু কিছু ব্যাংক স্পেশাল পরিদর্শনের আওতায় এসেছিল। আজকে সাধারণ আমানতকারীদের টাকা ফেরত না পাওয়া কিংবা ব্যাংকগুলো আমানতের টাকা ফেরত দিতে না পারার এটাও একটা বড় কারণ।

এখন মূল আলোচনায় আসি। সুদের হার বৃদ্ধির ফলে যারা প্রকৃত ব্যবসায়ী তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই ক্ষতি কেউ খুশি নিতে না পারলে তার ঋণটি খেলাপি হয়ে যেত। অনেক নতুন উদ্যোক্তা কিংবা পুরনো উদ্যোক্তাই যদি নতুন করে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেন তবে তার অর্থ যোগানটাই বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। একটি শিল্প প্রকল্প করতে গেলে মেশিনারিজ আমদানি থেকে শুরু করে র’ মেটেরিয়ালস বা কাঁচামাল আমদানি পর্যন্ত অনেকগুলো স্তর পার করতে হয়। পরিবেশ ছাড়পত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে। ওসব জায়গায় আবার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে অনেক শিল্প প্রকল্প ব্যাংকের ঋণ পেয়েছে কিন্তু বিদ্যুৎ বা গ্যাস সংযোগ পাননি। মেশিন এনে বসিয়ে রেখেছেন, কিন্তু স্টার্স্ট দিতে পারেননি। অপরদিকে ব্যাংকের কিস্তি প্রদানের সময় চলে এসেছে। স্বভাবতই, যে উদ্যোক্তা বিদ্যুতের অভাবে তার কারখানায চালু করতে পারেননি, তিনি কিভাবে নিয়মিত ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করবেন?

আবারও মূল‌্যস্ফীতিতে ফিরে যাই। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সুদের বাড়িয়ে দেয়া হলো। কিন্তু দুর্বল যেসব ব্যাংক ‘লুটে’র শিকার হয়েছে- সেসব ব্যাংক পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকার টাকা ছাপিয়ে যে সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে তার তার প্রভাবও কিন্তু বাজারে পড়ছে। আর টাকার ছড়াছড়ি থাকলে মূল্যস্ফীতি কমবে কীভাবে? যদিও সর্বশেষ খবরে দেখেছি চার-পাঁচ শতাংশে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনার একটা আশাবাদী বক্তব্য নীতিনির্ধারকরা দিয়েছেন। যদি তাই হয়, সেটা ইতিবাচক হবে কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সুদের হার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারটি ব্যবহারের ফলে শিল্প খাতে তথা কর্মসংস্থানমুখী বিনিয়োগকে আমরা নিরুৎসাহিত করছি। এখন সময় এসেছে বিকল্প কিছু ভাববার। রাজনৈতিক সরকারের কিছু টানাপড়েন থাকে, কিন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকারের তার ঊর্ধ্বে। তাই অন্তবর্তী কালীন সরকারের জন্য এটি বড় সুযোগ আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা নিয়ে আসা এবং প্রয়োজনে নজরদারি বাড়ানো। প্রথাগত সংস্কার আমরা চাই না, দীর্ঘ মেয়াদে একটি পরিবর্তনের জন্য কাঠামোগত পরিবর্তনই কেবল প্রত্যশিত সাফল্য এনে দিতে পারে। 

লেখক: জামাল উদ্দীন, সাংবাদিক।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল