নিজস্ব প্রতিবেদক:
‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে/আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’
পিঠা-পায়েসকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এখনো অসংখ্য গান, কবিতা ও ছড়া প্রচলিত আছে। আমাদের হাজারো সমস্যা সত্ত্বেও গ্রামবাংলায় এসব পিঠা-পার্বণের আনন্দ-উদ্দীপনা এখনো মুছে যায়নি। পিঠা-পার্বণের এ আনন্দ ও ঐতিহ্য যুগ যুগ টিকে থাকুক বাংলার ঘরে ঘরে।
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর বা সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে ব্যস্ত সময় কাটায় পিঠা তৈরিতে। অতিথি বিশেষ করে জামাইদের এ সময় দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো হয়। এ সময় খেজুরের রস থেকে গুড়, পায়েস এবং নানারকম মিষ্টান্ন তৈরি হয়। খেজুরের রসের মোহনীয় গন্ধে তৈরি পিঠা-পায়েস আরও বেশি মধুময় হয়ে ওঠে।
সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছে ভাপা পিঠা। এছাড়াও আছে চিতই পিঠা, দুধচিতই, ছিট পিঠা, দুধকুলি, ক্ষীরকুলি, তিলকুলি, পাটিসাপটা, ফুলঝুড়ি, ধুপি পিঠা, নকশি পিঠা, মালাই পিঠা, মালপোয়া, পাকন পিঠা, ঝাল পিঠা ইত্যাদি। বাংলাদেশে শতাধিক ধরনের পিঠার প্রচলন রয়েছে।
কালের গভীরে কিছু হারিয়ে গেলেও এখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। শীতকালে শুধু গ্রামবাংলায়ই নয়, শহর এলাকায়ও পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ইদানীং শহরেও পাওয়া যায় শীতের পিঠার স্বাদ।
একসময় এ দেশে যেমন শত শত নামের ধান ছিল, তেমনি সেসব ধানের পিঠারও অন্ত ছিল না। কত কী বিচিত্র নামের পিঠা! পিঠা তৈরি ছিল আবহমান বাংলার মেয়েদের ঐতিহ্য।
শীতকালের সবচেয়ে মজার খাবার কি-এই প্রশ্ন যদি সবাইকে করা হয় তবে আমার ধারণা বেশীরভাগ মানুষের উত্তর হবে ‘পিঠা’। সত্যি শীতকালের রসালো ও সুমিস্ট নানা রকমের নানা পদের পিঠার স্বাদ যে পায়নি তার জীবন বৃথা।
পিঠা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের একটি অংশ। শীতের আগমন ঘটলেই সবার মনে পরে যায় শীতের পিঠার কথা। পিঠা ছাড়া বাংলার শীত পরিপূর্ণ হয় না। কনকনে শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে পিঠা খাওয়া গ্রামের অতি পরিচিত দৃশ্য। শীতের পরিচিত এই অনুষঙ্গ পিঠার চল ইদানিং রাজধানীতেও দেখা যায়। পাড়ার মোড়ে মোড়ে নানা ধরণের পিঠার পসরা সাজিয়ে অস্থায়ী দোকান খুলে বসেন অনেকেই। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই সব পিঠার দোকানকে অনেক নোংরা মনে হলেও এসব দোকানে কিন্তু বিক্রি-বাট্রা মোটেও কম হয় না। ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়িসহ সকল বয়সের, সকল পেশার মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পরখ করেন ভাপা, চিতই পিঠার স্বাদ।
অনেক সময় দেখা যায় এই সব দোকান থেকেই পিঠা অর্ডার দিয়ে তৈরী করে বাড়িতে বসে পরিবারের সবাই মিলে তা মজা করে উপভোগ করেন। আসলে ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ঘরে পিঠা বানানোর সময় মেলা ভার। বাইরের দোকানই ভরসা। তাই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ এসব পিঠার দোকানই আমাদের শহুরে জীবনের পিঠা রসনার অন্যতম ভরসা। অবশ্য এখন ঢাকায় অনেক নামী-দামী হোটেলেও হরেক রকমের শীতের পিঠা পাওয়া যায়।
ভাপা পিঠা
ভাপা পিঠা চালের গুঁড়া, গুড়, নারকেলের শাস দিয়ে জলীয় বাষ্পের ভাঁপে তৈরি করা হয়।
ভাঁপে তৈরি করা হয় বলেই এ পিঠার নাম ভাপা পিঠা।অনেক অঞ্চলে এ পিঠা ধুপি নামেও পরিচিত।
রাস্তাঘাটে এমনকি রেস্তোরাঁয়ও আজকাল ভাপা পিঠা পাওয়া যায়। এ পিঠার নানা ধরনের মধ্যে আছে মিষ্টি ভাপা ও ঝাল ভাপা।
চিতই পিঠা
চালের আটা পানিতে গুলিয়ে গরম তাওয়ায় তৈরি করা হয় চিতই পিঠা। বিভিন্ন ভর্তা কিংবা মাংস দিয়ে খেতেও মজা লাগে এই পিঠা।
আবার দুধ বা খেজুরের রস একসঙ্গে জ্বাল দিয়েও তৈরি করা যায় রস পিঠা বা দুধ চিতই। এ ছাড়াও ইলিশ মাছ দিয়ে এখন চিতই পিঠা বানানো হয়। পুরান ঢাকায় ডিম পিঠা খুবই জনপ্রিয়।
পাটিসাপটা
খেলে মনে হবে একসঙ্গে কয়েকটি পাটিসাপটা খাওয়া যাবে।
সুজি, ময়দা , চালের গুঁড়া, চিনি, দুধ, কোড়ানো নারকেল, ক্ষীর, মাওয়া, ঘি, লবণ এবং তেলের সংমিশ্রণে তৈরি হয় পাটিসাপটা।
খেতে নরম হওয়ায় ছোট থেকে শুরু করে বয়স্ক সবাই এ পিঠা পছন্দ করেন।
পুলি পিঠা
খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় পুলি পিঠা খুবই জনপ্রিয়।
পুলি পিঠার প্রধান উপকরণ চাল। এরপর পছন্দমতো উপকরণে নানা ধরনের পুলি পিঠা বানানো যায়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের পুলি পিঠা তৈরি করা হয়। যেমন- নারকেলপুলি, দুধপুলি, ঝালপুলি, ভাপাপুলি ও ক্ষীরপুলি।
তেলের পিঠা
চালের গুঁড়া, চিনি, গুড় অথবা খেজুরের রস, লবণ ও তেল দিয়ে এ পিঠা তৈরি করা হয়।
ডুবো তেলে ভেজে বানানো হয় বলে একে তেলের পিঠা বলা হয়।
এটি খুবই মজাদার একটি পিঠা। শীতে এ পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়।
বিবিখানা পিঠা
শীতে খেজুরের রসে তৈরি হয় নানা ধরনের পিঠা। খেজুরের রসের তৈরি বিবিখানা পিঠাও তার মধ্যে একটি।
চালের গুঁড়া, খেজুরের ঘন রস, ডিম, লবণ সামান্য, দুধ ও ঘি দিয়ে তৈরি করা হয় মজার স্বাদের এ পিঠা।
খোলাজা পিঠা
নোয়াখালীর জনপ্রিয় পিঠা খোলাজা পিঠা। চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় খোলাজালি বা খোলাজা পিঠা।
মাংস দিয়ে এ পিঠা বেশ মানিয়ে যায়। তবে হাঁসের মাংস দিয়েই খেতেই বেশি মজা।আপনি চাইলে নারকেল ও গুড় দিয়ে খেতে পারেন। শীতকালে রসে ভিজিয়েও খাওয়া যায় মজাদার এ পিঠা।
ম্যারা পিঠা
শীত আসবে আর মেরা পিঠা খাবেন না, তাই কি হয়! নতুন গুড় উঠতে শুরু করবে আর কদিন পরেই।
এসময় নানা স্বাদের পিঠা তৈরি হবে ঘরে ঘরে। মেরা পিঠা তৈরির পদ্ধতি খুব সহজ। এটি খেতেও ভীষণ সুস্বাদু। শীতের বিকেলক এই পিঠা আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলবে।
তানহা আজমী