সময় জার্নাল ডেস্ক:
আস্থা কাচা-ঝালা বলেন, ‘চাঁদ বা মঙ্গগ্রহে বসবাসের জায়গা খুবই কম হবে, এমন চিন্তা মাথায় রেখেই হাব-১ এর নকশা করা হয়েছে। মহাকাশচারীদেরও খুবই কম পানি ব্যবহার করতে হবে, এজন্য আমরা একটি ড্রাই টয়লেটের ব্যবস্থা করেছি। এই বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ঘরটি যেন দুর্গন্ধমুক্ত থাকে –তাও আমরা নিশ্চিত করেছি।’
ডিম্বাকৃতির স্থাপনাটি প্রথম দর্শনেই মনে হয় কিম্ভূত, যদিও ভারতের মহাকাশচারীদের ভবিষ্যতের আবাস এমনভাবেই নকশা করা হয়েছে। দেশটির মহাকাশ সংস্থা- ইসরোর সর্বপ্রথম এনালগ মিশনের অংশ হতে হ্যাবিটেট-১ বা সংক্ষেপে হাব-১ নামের এই আবাস নিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। খবর বিবিসির।
এনালগ মিশন বলতে, পৃথিবীতেই মহাকাশ বা ভিন গ্রহের মতো পরিবেশ তৈরি করে– সেখানে নভোচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়াকে বোঝানো হচ্ছে। সম্প্রতি তারই অংশ হিসেবে এই আবাসটি ভারতের লাদাখে হিমালয় পর্বতশ্রেণির সুউচ্চ স্থানে স্থাপনের পর তিন সপ্তাহ ধরে পরীক্ষা করা হয়।
ইসরোর সঙ্গে বেসরকারি কিছু সংস্থাও কাজ করে। গুজরাটের এমনই একটি কোম্পানি ইসরোর ঠিকাদারি পেতে কাজ করছে। আকা- নামের ওই কোম্পানির মহাকাশ স্থাপত্যবিদ আস্থা কাচা ঝালা বলেন, মহাকাশচারী ও মহাকাশ সরঞ্জাম ভিন গ্রহে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে— মিশনে পাঠানোর আগেই আমরা এসব সিম্যুলেশনের মাধ্যমে তা শনাক্ত করে সমাধান করার চেষ্টা করি।
তিনি জানান, হাব-১ তৈরি করা হয়েছে মহাশূন্যে ব্যবহারযোগ্য, হালকা অথচ অত্যন্ত মজবুত টেফলন উপাদান দিয়ে। তাপনিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে শিল্পকাজে ব্যবহৃত ফোম। মহাকাশচারীদের জন্য এখানে রসদ ও জরুরি সরঞ্জাম মজুতের ব্যবস্থাও আছে। রয়েছে খাবার গরম করার জায়গা ও বাথরুম। ভিনগ্রহে বসবাসের মতো করে সাজানো পরিস্থিতিতে এই ঘরটিতে তিন সপ্তাহ কাটান একজন মহাকাশযাত্রী।
আস্থা কাচা-ঝালা বলেন, 'চাঁদ বা মঙ্গগ্রহে বসবাসের জায়গা খুবই কম হবে, এমন চিন্তা মাথায় রেখেই হাব-১ এর নকশা করা হয়েছে। মহাকাশচারীদেরও খুবই কম পানি ব্যবহার করতে হবে, এজন্য আমরা একটি ড্রাই টয়লেটের ব্যবস্থা করেছি। এই বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ঘরটি যেন দুর্গন্ধমুক্ত থাকে –তাও আমরা নিশ্চিত করেছি।'
লাদাখে ভারতের প্রথম স্থায়ী স্পেস সিম্যুলেশনের জায়গা তৈরি করতে বর্তমানে ইসরোর সঙ্গে আলোচনা করছেন এই নারী উদ্যোক্তা। ভারতের মহাকাশ সংস্থা যখন নিজস্ব মহাকাশযানে প্রথম মহাকাশচারী পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে– তারমধ্যেই চলছে এ আলোচনা।
ইসরোর গগণযান মিশনের পরিকল্পনায়, পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে তিনজন মহাকাশচারীকে তিন দিনের জন্য পাঠানোর কথা রয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে, আগামী বছরের কোনো একসময় মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা হবে। ভারত ২০৩৫ সালের মধ্যে মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ করতে চায়, এবং ২০৪০ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর লক্ষ্য নিয়েছে।
ভারতের প্রথম এনালগ স্পেস মিশনের অংশ হিসেবে তিন সপ্তাহ লাদাখে কাটান মহাকাশ অভিযাত্রীরা। ছবি: আকা স্পেস স্টুডিও/ ভায়া বিবিসি
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি, রাশিয়া, চীনসহ অন্যান্য দেশের সরকারি-বেসরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলোও কয়েক ডজন সিম্যুলেশন মিশন পরিচালনা করছে। ভারতের গগণযান মিশনে অংশ নিতে চলেছেন– এমন দুই মহাকাশচারী বর্তমানে নাসার অধীনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
এই প্রকল্পের সহযোগী লাদাখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অধ্যয়নের ডিন সুব্রত শর্মা বলেন, 'একবার আমাদের নিজস্ব সিম্যুলেশন মিশন প্রস্তুত হয়ে গেলে, তখন আর বিদেশি মহাকাশ সংস্থায় গিয়ে আমাদের নভোচারীদের প্রশিক্ষণ নিতে হবে না।'
মহাকাশ বিষয়ক পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য লাদাখকে বেঁছে নেওয়ার কারণ তুলে ধরে তিনি জানান, 'ভৌগলিক দিক থেকে এ অঞ্চলের রুক্ষ, পাথুরে ভূমির গঠন ও মাটির সাথে মঙ্গল বা চাঁদের কিছু অংশের পাথর ও অন্যান্য উপাদানের সাদৃশ্য আছে। ফলে এই অঞ্চল মহাকাশ (বা ভিন গ্রহের পরিবেশ) গবেষণার জন্য আদর্শ।'
ইসরোর গগণযান মিশনের সময় সংগৃহীত নমুনাগুলো লাদাখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারেও পরীক্ষা করে দেখা হবে; যার উদ্দেশ্য হবে মহাকাশচারীরা ভিনগ্রহে পাওয়া পদার্থ দিয়ে বসতি নির্মাণ করতে পারবেন কিনা– তার অনুসন্ধান করা।
ভারত-চীন সীমান্তে হিমালয় পর্বতমালার বুকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১ হাজার ৪৮৩ ফুট উঁচুতে লাদাখ অবস্থিত। এখানকার জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। দিনের বেলায় যেখানে তাপমাত্রা সর্বনিম্ন মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে সর্বোচ্চ ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠতে পারে।
সে তুলনায়, মঙ্গলগ্রহে তাপমাত্র মাইনাস ১৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামতে পারে, আর চাঁদের কিছু গিরিখাদ অঞ্চলে তা নামতে পারে মাইনাস ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। ততোটা বৈরী নাহলেও– লাদাদের জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতি মানবদেহের সহনশীলতা যাচাইয়ের জন্য অনেকটাই উপযুক্ত বলে জানান অধ্যাপক শর্মা। তিনি বলেন, মহাকাশের মতো পরিবেশ যেখানে তৈরি করা সম্ভব— সেখানে এসব স্থাপনা নির্মাণের দরকার আছে।
'তাছাড়া, লাদাখ ভারতের এমন একটি অঞ্চল যেখানে মাইলের পর মাইল জুড়ে রয়েছে রুক্ষ ও পাথুরে জমি। এই দৃশ্য আপনি যেন ভিনগ্রহে রয়েছেন এমন অনুভূতি দেয়'- তিনি যোগ করেন।
সিম্যুলেশনের অংশ হিসেবে এই শীতল মরুর পরিবেশে ক্যাপসুলের মতো ঘরটিতে তিন সপ্তাহ সময় কাটানো মহাকাশ অভিযাত্রীরাও এমন কথাই বলেছেন।
এমআই