মো. ফুয়াদ হাসান
যিনি বজ্রকন্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি মন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই’। যার মন কাঁদতো কৃষক, শ্রমিক, মজুর আর মেহনতি মানুষের জন্য। যিনি পরাধীনতার শিকল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করেছিলো। দীর্ঘ ২৩ বছরের আঁধার থেকে আলোর পথ দেখিয়েছিল গণ মানুষকে। যিনি লড়াই করেছে বাঙালির মুক্তির জন্য, বাঙালির আধিকারের জন্য। তিনি আর কেউ নয়, তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিজের আত্মত্যাগ আর ব্যক্তিত্ব বলেই হয়েছিলো জগৎ বিখ্যাত।
তাইতো কিউবার বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাটি তার সম্পর্কে বলেছিল, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনো জন্ম নিতো না’। রাজনীতিটা তিনি করতেন গণমানুষের জন্য। এতো মহত্ত্ব আর গৌরব তো আর এমনি এমনি আসেনি এসেছে তার মানবতাবোধ এবং সুন্দর আদর্শর গুনে। যে মানুষটা সারা জীবন যুদ্ধ করেছেন মেহনতি, দুঃখি, অনাহারী, মূক বাঙালির মুক্তির জন্য। তিনি বাংলার মানুষের দুঃখ, কষ্ট ও বাংলার মানুষের জন্য সেই শৈশবকাল থেকে ভাবতেন। একদিন শিশু মুজিব স্কুলে গিয়ে দেখেন তাঁর সহপাঠীরর বই-খাতা নেই।
সে নিজের বই- খাতা বন্ধুকে দিয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাবা শিশু মজিবকে কাছে ডেকে বললো, ‘তোমার বই-খাতা কথায় ফেলে এসেছো?’ মুজিব বললেন, ‘তার এক গরীব বন্ধুকে দিয়েছে।‘আমাদের তো টাকা আছে তুমি আবার আমাকে কিনে দিতে পারবে, কিন্তু আমার বন্ধুর তো টাকা নাই, ও কিনতে পারবে না। এভাবেই মানবতা আর আত্মত্যাগের বাণী ছড়িয়েছে শৈশব থেকেই।
ভাসানী সাহেব বঙ্গবন্ধুর হাতে আটআনা পয়সা দিয়ে একটি কাজে নারায়ণগঞ্জে পাঠিয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কাজ শেষ করে বিকালে এসে মাওলানা ভাষানীর হাতে আটআনা পয়সাই ফেরত দেন, ভাসানী সাহেব খুবই অবাক হলেন! জিজ্ঞাসা করলেন, ঘটনা কি মুজিব, তুমি নারায়ণগঞ্জ কীভাবে গেলে? বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, সাইকেল করে গিয়েছি, টাকাটা বেঁচে গেছে’। এভাবেই জনগণের সম্পদ রক্ষা করতেন তিনি।
কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় আজ তার দেশেই গরীবের মাল লুট হয়। ১৯৭৪ সালে সারাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মন খারাপ কিন্তু মনোবল ছিল অটুট। ঐ সময় একদিন নুরুল ইসলাম ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাসায় গেলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে। ভেতরে প্রবেশ করে দেখল বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে মোড়ার উপর বসে আছেন। নুরুল ইসলামকে দেখে বললেন, ‘‘আসো আসো, আমি তো প্রতিদিন মুড়ি খাই তুমি খাবা?’’ এমন সাধারণ জীবনযাপন করতেন বঙ্গবন্ধু। একবার তাঁর এলাকার কিছু কৃষিজীবী মানুষ ফষল অজন্মার কারণে খাদ্যাভাবে কষ্ট পায়। শেখ মুজিব তাঁর ঘরের সঞ্চিত ধান-চাল তাদের মধ্যে বিতরণ করেন। এভাবেই অন্যের কষ্টে নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়েছেন বাঙ্গলির জাতির জনক।
বঙ্গবন্ধু তার বিরোধীদেরও সম্মান করতেন, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন৷ এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতা বিরোধী মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর গ্রেফতার হলে জেলখানায় তার যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে ব্যাপারেও সচেতন ছিলেন উদারচেতা বঙ্গবন্ধু। কিন্তু অপ্রিয় সত্যে এটাই যে আজ বাঙালির ভিতরে নেই তাদের জাতির পিতার আদর্শ। এক নেতাকে একবার এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলো আচ্ছা আপনি মুজিবকোট কেন পরেন? সে নেতা জবাব দিয়েছিলো এটা বঙ্গবন্ধু পরতেন বলে পরি, এটা আদর্শ। আসলে বঙ্গবন্ধু পরতেন বলে এটি আদর্শ নয়, আদর্শ ছিল এই কোট পরার পিছনের চিন্তাধারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক ছাত্র একবার তাজউদ্দীন আহম্মেদের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। ছেলেটা অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখলো। হুট করে ছেলেটা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করল, আপনার কোটের বোতাম ছয়টা কেন? এ ধরনের কোটে বোতাম আরও বেশি থাকার কথা। প্রশ্ন শুনে বঙ্গবন্ধু ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন এমন প্রশ্ন আমাকে আগে কেউ করে নাই, তুমি প্রথম।
এই ছয়টি বোতাম হলো আমার ঘোষিত ছয় দফার প্রতীক। ছয়টি বোতাম ছয় দফার ছয়টি দাবি ধারণ করে। এই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা, যিনি একটা কোটের মধ্যে ধারণ করেন দাবি ও ন্যায্যতা। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট (১৯৭২ সালের এক সাক্ষাত্কারে) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি। ’ ‘আর আপনার দুর্বল দিকটা কী?’ বঙ্গবন্ধুর উত্তর, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি। ’ এই হলেন বাঙালির জনক বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে এসেছিলেন দেশের মানুষকে ভালোবেসে। ক্ষমতার লোভ কিংবা খ্যাতি, যজ তাকে কখন লক্ষ্চ্যুত করতে পারে নি।তাইতো দেশ ও দেশের মানুষের জন্য হাসি মুখে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে কারাগারে। তবুও দেশ, মা- মাটির ভালোবাসার জন্য কারো কাছে মাথা নত করেনি। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, আজকের তরুণ প্রজন্মেরর মাঝে নেই তাদের জনকের সেই আদর্শ,সেই মানবতার দর্শন।
পশ্চিমা সংস্কৃতি আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত তরুণ সমাজ আজ অন্ধ অনুকরণে আবদ্ধ। দেশ আর মানবতা নিয়ে ভাববার সময় কোথায় তাদের । তাইতো গুনীরা বলেন,"বড় নেতার পাশে দাড়িয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোট দিলেই নিজেকে বড় নেতা ভেবো না।নিজের কর্মের দ্বারা নিজেকে প্রমাণ করো" চার দিকে অন্যায়, ক্ষুধা, মেহনতী মানুষের আহাজারীতে বাতাস ভারি। কিন্তু কথায় নজরুল-সুকান্তের সেই তরুণ,কখায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক,কথায় বাংলার সোনার সন্তানরা।বাঙালির অতীত ইতিহাস থেকে জানা যায়,ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সকল ক্ষেত্রে তরুণরাই সবার আগে বুক পেতে দিয়েছে শকুনের নোংরা থাবার সামনে। বঙ্গবন্ধু বারবার বলতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’।
আজকের তরুণই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই বাঙালির বীরগাথা আর জাতির জনকের আদর্শ বুকে ধারণ করে, আজকের তরুণরাই গড়ে তুলবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ, এমনটাই আশা করে সকলের।
লেখক: মো:ফুয়াদ হাসান, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
অর্থসম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
সময় জার্নাল/আরইউ