ফয়সাল আহমেদ:
বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রায় ২৮ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা, যা বাংলা ভাষাকে বিশ্বের সপ্তম সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষার মর্যাদা দেয়। আর মাতৃভাষার ভিত্তিতে বাংলা বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে, প্রায় ২২ কোটিরও বেশি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা।
ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির পরিচয় ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বাহক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার রাজপথে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন একঝাঁক ভাষা সৈনিক। অধিকার ও ভাষাগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০০ সাল থেকে এটি বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে, যা বিভিন্ন ভাষার প্রতি সম্মান ও সংরক্ষণের গুরুত্বকে তুলে ধরে।
৫২ তে যে ভাষার জন্য রক্তঝরা আন্দোলন, সেই ভাষা দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মাননা পেলো। কিন্তু আজ বিদেশি ভাষার প্রতি তারুণ্যের ঝুঁকে পড়ার এই সময়ে, কমেছে মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা। প্রায় ৭৩ বছর পর কতটুকুই বা মাতৃভাষাকে ধারণ করছে তারুণ্য? তবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও রয়েছে মাতৃভাষার প্রতি নিগাঢ় টান ও ভালোবাসা। তেমনি কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাতৃভাষার তাৎপর্য নিয়ে তাদের ভাবনা শুনেছেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও 'সময় জার্নাল' এর প্রতিনিধি মোঃ ফয়সাল আহমেদ।
মাতৃভাষাঃ পরিচয়ের শক্তি নাকি শুধুই বিস্তৃত অতীত?
ভাষা কেবল যোগাযোগ নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। তবে বিশ্বায়নের ছোঁয়ায় মাতৃভাষার গুরুত্ব ধীরে ধীরে ম্লান হচ্ছে। ইংরেজিসহ নানান বিদেশী ভাষার আধিপত্য ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে অনেকেই মাতৃভাষা চর্চায় উদাসীন হয়ে পড়ছে। অথচ মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ছাড়া সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মাতৃভাষার গুরুত্ব অমর। ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় গৌরব, যা তরুণদের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। মাতৃভাষার সঠিক চর্চা না হলে জাতীয় পরিচয় সংকটের মুখে পড়তে পারে।
তাই আমি বলবো, আসুন, মাতৃভাষাকে সম্মান করি, চর্চা করি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই ঐহিত্যকে সমৃদ্ধ করে রাখি। কারণ একটি শক্তিশালী ভাষা মানেই একটি শক্তিশালী জাতি।
সাদিক মাহমুদ সাকিব
শিক্ষার্থী, পুরকৌশল বিভাগ,
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
মায়ের ভাষার প্রতি যত্নশীল হওয়া দরকার
মায়ের ভাষা হলো আমাদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি, আমাদের পরিচয়ের প্রথম সূত্র। মায়ের ভাষার প্রতি যত্নশীল হওয়া মানে শুধু ভাষাটি সংরক্ষণ করাই নয়, বরং এর মাধুর্য, গভীরতা এবং বিশুদ্ধতা বজায় রাখা। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি বহন করে। তাই এ ভাষাকে অবহেলা করা মানে নিজের শিকড়কে উপড়ে ফেলা। মায়ের ভাষার প্রতি যত্নশীল হলে আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে পারব, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারব।
মায়ের ভাষা আমাদের জ্ঞানার্জনের প্রথম মাধ্যম। এর মাধ্যমেই আমরা প্রথম শিক্ষা গ্রহণ করি, নতুন জিনিস শিখি। মায়ের ভাষা আমাদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে সহায়তা করে। মায়ের ভাষার চর্চা করা এবং এর বিকাশে অবদান রাখা আমাদের কর্তব্য।
আহমেদ জিনান
শিক্ষার্থী, কলা অনুষদ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে মাতৃভাষার গুরুত্ব
আজকের বিশ্বায়নের যুগে মাতৃভাষার গুরুত্ব কমছে। ইংরেজির আধিপত্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও সামাজিক মাধ্যমে বাংলা উপেক্ষিত হচ্ছে।
নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষার সঠিক চর্চা করছে না। বিদেশি ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বাংলার শুদ্ধ ব্যবহার ভুলে যাচ্ছে। ভাষার বিকৃতি ও সংমিশ্রণ মাতৃভাষার সৌন্দর্য নষ্ট করছে।
ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক। মাতৃভাষাকে অবহেলা করা মানে নিজস্ব ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা। তাই আমাদের উচিত বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা।
শিক্ষা, সাহিত্য ও প্রযুক্তিতে মাতৃভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে। ঘরে ও বাইরে বাংলা চর্চা করলেই মাতৃভাষার গুরুত্ব টিকে থাকবে। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসাই আমাদের প্রকৃত দায়িত্ব।
সায়েম হোসেন
শিক্ষার্থী, পুরকৌশল বিভাগ,
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
বাংলা ভাষার স্বয়ংসম্পূর্ণতাঃ এক অপূর্ণ বাস্তবতা
বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা, স্বাধীনতার জন্য যে ভাষার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে, সেই ভাষাকে আমরা আজও পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে পারিনি। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, আইনসহ অনেক আধুনিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় ইংরেজির উপর নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে, যা আমাদের ভাষার পরিপূর্ণ বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
তাছাড়া, সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে বাংলার ব্যবহার সীমিত, প্রযুক্তির জগতে বাংলা অনুবাদ ও সফটওয়্যারও তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে। ভাষার স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে প্রয়োজন এর সর্বস্তরে ব্যবহার, আধুনিক পরিভাষার সৃষ্টি, এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। নইলে বাংলা শুধু আবেগের ভাষা হয়েই থাকবে, বাস্তব জীবনের সর্বত্র তার শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারবে না।
খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ পল্লব
শিক্ষার্থী, পুরকৌশল বিভাগ,
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।
ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ও আমাদের জন্য শিক্ষা
ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের এই আন্দোলন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এ আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকারের জন্য নয়, বাঙালির জাতীয় পরিচয় গঠনেরও একটি মাইলফলক। এর মাধ্যমে আমরা শিখেছি যে, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা প্রতিটি জাতির কর্তব্য। আমরা যেন বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা করি, ভাষাকে বিকৃত না করি এবং নতুন প্রজন্মকে মাতৃভাষার গৌরব সম্পর্কে সচেতন করি।ভাষা আন্দোলনের চেতনা আমাদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব তুলে ধরে, যা একটি শক্তিশালী জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য।
মুঃ জহুরুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ,
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
বাঙালি হিসেবে আমরা এক গর্বিত জাতি
বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা, যার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গর্বের বিষয়। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা।
বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রসহ অনেক গুণী সাহিত্যিক বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে সম্মানিত করেছেন। তাঁদের সাহিত্য বাংলা ভাষার মর্যাদা বাড়িয়েছে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রমাণ করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়, যা মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক।
বাংলা ভাষা আমাদের ঐক্যের প্রতীক এবং সাহিত্য, সংগীত, নাটক ও চলচ্চিত্রে এর গভীর প্রভাব রয়েছে। এটি আমাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও মূল্যবোধের রক্ষক।
অতএব, বাংলা ভাষা আমাদের গর্বের প্রতীক। এর চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের শেকড়কে শক্তিশালী করি এবং বিশ্বে আমাদের পরিচিতি বাড়াই।
অর্ণব আল মামুন
শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এমআই