ডা. হাছিব মোহাম্মদ ::
তখন ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ছিলাম। একজন মহিলাকে মৃত ঘোষণার পর দেখি- তার ছেলে মায়ের শরীর থেকে স্বর্ণের গহনা খুলে নিচ্ছে। মৃত্যুর পর এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। শরীর ফুলে গেলে তখন গহনা সরানো যায় না।
ঘটনার এক ঘন্টা পর আরেক ছেলে ইমার্জেন্সিতে এসে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। সে ভাই নাকি স্বর্ণ নিয়ে পালিয়েছে। ওটাতে তারও ভাগ ছিল। মায়ের মৃত্যু ছাপিয়ে স্বর্ণের জন্য সে ছেলের কান্নায় আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম।
মেডিকেল সেক্টরে আমার বয়স প্রায় ২০ বছর। অসংখ্য মৃত্যু আর অপমৃত্যুর স্বাক্ষী আমি।
একবার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একজন মানুষকে লোকজন ধরাধরি করে রেখে গেল। এদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পর সবার আগে খোয়া যায় প্রাণ, তারপর মোবাইল, তারপর মানিব্যাগ। আমি তার রক্তাক্ত দেহ হাতিয়ে ক্যাশমেমো জাতীয় একটা কাগজ পেলাম। সে নাম্বারে ফোন দিলাম। একজন ভদ্রমহিলা ফোন ধরলেন। একসময় বুঝলাম ভদ্রমহিলা মৃত লোকটির প্রাক্তন স্ত্রী।
নতুন করে সংসার পেতেছেন চট্টগ্রামে। তিনি আসতে পারবেন না। পরিচিত অন্য কারো ফোন নাম্বার আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানালেন- উনাদের পরিবারের কারোর সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই, ফোন নাম্বার ও নেই। ছেলের ফোন নাম্বার আছে। কিন্তু ও দেশের বাহিরে থাকে। উপজেলায় আপনারা এতক্ষণ লাশ রাখতে পারবেন না। কবর দিয়ে দেন।
তিনি ফোনটা কেটে দিলেন।
ইমার্জেন্সীতে এসে একবার এক বাপের দু-কন্যার ঝগড়া! সে কি ঝগড়া! কে ডেথ্ সার্টিফিকেট নিবে!
ইন্সুইরেন্স কোম্পানি আর ব্যাংকের ব্যাপার-স্যাপার।বললাম- টস করে ফেলেন। দুজনের গালে একই ওজনের দুটা চড় দিবো। যিনি ব্যথা পাবেন না। তিনি জয়ী হবেন। তারা দুজনেই বাঁকা চোখে আমার দিকে কটমট করে তাকালো।
তিনটা ঘটনাই শহরের তিনটা শিক্ষিত পরিবারের। আমার দুঃখ লাগে- বাবাগুলো তারপর ও নিজেকে সময় দেয়। অফিস থেকে বের হয়ে আড্ডা দিয়ে আসে, অনেক সময় বন্ধুদের নিয়ে ট্যূরে বের হয়। আর মায়েরা সন্তান আর এক পরিবারের পিছনে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়।
মৃত্যুর পর যদি মানুষের পার্থিব পূনরুত্থান হতো, তাহলে সে সবচাইতে বেশি ঘৃণা করতো তার সন্তানকে।
হেলুসিনেশন-১৩
হাছিব ১/৭/২১