তাসকিয়া চৌধুরী মহুয়া:
সামনে আসছে গরমকাল। গ্রীষ্মকাল অপছন্দনীয় হলেও অনেকেই এই ঋতু পছন্দ করেন। কারণ, হরেক রকমের ফল সবচেয়ে বেশি এই গরমকালেই পাওয়া যায়। ফলের রাজা আম থেকে শুরু করে জাতীয় ফল কাঁঠাল- সব-ই পাওয়া যায় এই মিষ্টি গরমকালে। কিন্তু, ফল কিনতে গেলেও অনেকে দ্বিধাবোধ করেন। তাদের মুখে একই কথা, " ফল কি আর আসল ফলের মতো? সব তো ফরমালিন! " কিন্তু আসলে এই ফরমালিন আমাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর?
ফরমালিন হলো ফরমালডিহাইড গ্যাসের একটি সম্পৃক্ত জলীয় মিশ্রন। ফরমালিন একটি অত্যন্ত উদ্বায়ী পদার্থ( সহজে উড়ে যায় এমন) যা প্রোটিনযুক্ত খাবারের সাথে বিক্রিয়া করে, কিন্তু ফলের সাথে বিক্রিয়া করে না। কারণ, ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল এবং ফাইবার থাকলেও প্রোটিনের পরিমান খুবই কম থাকে। যেমন: প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা আমে ০.৬ গ্রাম, ড্রাগন ফলে ০.৮ গ্রাম, কাঁঠালে ০.৫ গ্রাম, কলাতে ১.৩ গ্রাম, বিটরুটে ১.৩ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়। যেহেতু ফলে প্রোটিন এর পরিমান খুবই কম থাকে, সেহেতু ফলসমূহ ফরমালিনে রাখলেও তেমন ক্ষতি হয় না।
কেননা, পরবর্তীতে ফলসমূহ পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ফলে উপস্থিত ফরমালিন বের হয়ে যায়। ফরমালিন ফলে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, এই সামান্য ফরমালিন কি ফলের পুষ্টিগুণ নষ্ট করে? ফরমালডিহাইড মূলত সামান্য পরিমাণে প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে উৎপন্ন হয়। এটি ফল এবং কিছু খাবারেও প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়, যা ক্ষতিকারক হওয়ার সম্ভাবনা কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আপেল, কলা, গাজর, পেঁয়াজ, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শসা, পালং শাক, টমেটো, নাশপাতি, আলু, তরমুজ, গরুর মাংস, পোল্ট্রি, চিংড়ির মতো অনেক খাদ্য সামগ্রীতে ফর্মালডিহাইড থাকে। এমনকি মানুষও প্রাকৃতিকভাবে ফর্মালডিহাইড তৈরি করে এবং এটি কিছু অ্যামিনো অ্যাসিড উৎপাদনের মতো মৌলিক জৈবিক কার্যাবলীর জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু তারপরও অনেকে দেখা যায় যে, ফরমালিন দেয়া আছে, শরীরে ক্ষতি করবে- এর জন্য অনেকেই ফল কিনে খেতে ভয় পান। যেমন : আপেল। কিন্তু অনেকেই এটা জানেন না যে, আপেল প্রাকৃতিকভাবে ত্বকে ফরমালডিহাইড তৈরি করে এবং সেই ফরমালিন খাওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে- ফলকে তাজা রাখতে যদি ফরমালিন না-ই কাজ করে, তবে ফলগুলো কিভাবে এত দিন তাজা থাকে? এর উত্তর আমাদের আশে পাশের পরিচিত ফলগুলোর দিকে তাকালেই পাওয়া যাবে। আমাদের অতি পরিচিত ফল, যেমন: আপেল, মালটা , আঙ্গুর - এই ফলগুলোর বাইরের আবরণে ছোট্ট ছোট্ট ছিদ্র দেখা যায়। সেসব ছিদ্র দিয়ে ফলের অভ্যন্তরীণ জলীয় বাষ্প বের হয়ে যায়, এবং বাইরের জলীয়বাষ্প ফলে ঢোকে। এই ফলগুলোর উপর একটি মোমের প্রলেপ দেয়া হয়, যা ফলগুলোকে পরবর্তীতে তাজা রাখে। এছাড়া ফল উৎপাদনের সময় যেসব রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়, সেসব ফল লবণ পানিতে ২-৩ মিনিট ভিজিয়ে রেখে খাওয়া উচিত। কারণ, লবণ এক ধরনের জীবাণুনাশক, যা কীটনাশক এর কেমিকেলকে প্রশমিত করে দেয়।
তাহলে ফলে কোন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকার জন্য ফলের গুণাগুণ প্রতিনিয়ত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যার জন্য একটি বিশাল গোষ্ঠী ভিটামিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে? ফল ও সবজির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার পিছনে আসল সমস্যা হলো- চাষের সময় এগুলোতে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার। ফল উৎপাদনের সময় অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করার কারণে ভারী ধাতু ফলে জমা হয়, যা মানুষের জন্য অনিরাপদ। আবার অনেক সময়, দূষিত মাটিতে ফল ও সবজি উৎপাদন করা হয়। যার ফলে ক্ষতিকর ধাতুসমূহ ফল থেকে মানুষের শরীরে পৌঁছায়।
সবশেষে, আমরা বলতে পারি যে- ফরমালিন আমাদের মিষ্টি ফলসমূহের জন্য ক্ষতিকর নয়। এটি একটি ভুল ধারণা। কিন্তু আমাদের সকলেরই উচিত ঋতুভিত্তিক ফল খাওয়া। যে ঋতুতে যে ফল পাওয়া যায়, সে ফল তখন -ই খাওয়া উচিত। কারণ, ঋতুর বাইরে ফল খাওয়ার অর্থ হলো, কৃত্রিম উপায়ে সংরক্ষিত ফল শরীরে রোগের বাসা বাঁধতে পারে। সুতরাং ফল আমাদের ঔষুধ। আমাদের দায়িত্ব হলো, আমরা যেন ফলকে আমাদের বিষ হতে না দেই।
লেখক:তাসকিয়া চৌধুরী মহুয়া
কনটেন্ট কো-লিড, নিউট্রেশন ফর চেইঞ্জ ও
শিক্ষার্থী, গভঃ কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সাইন্স।