মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন:
ঈদের আমেজে খুশি সবাই। ২৫ দিনের টানা ছুটিতে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা বাড়িতে সময় কাটাচ্ছেন। তবে এই ছুটি সবার জন্য খুশির কারণ নয়। কেউ চাচ্ছেন দ্রুত ছুটি শেষ হোক, কেউবা বর্ধিত ছুটি চাচ্ছেন। এর কারণ অনুসন্ধান করেছেন মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন। ঘটনা প্রবাহে তুলে ধরা হয়েছে তা।
ঘটনা প্রবাহ-০১ঃ আমি রোহান, হাবিপ্রবিতে ভর্তি হয়েছি আজ ৫ বছর ২ মাস প্রায়। এখনো অনার্স সম্পন্ন হয়নি। মানুষের প্রশ্ন একটাই- পড়াশোনা শেষ কিনা বা চাকরি বাকরি করছি কিনা? এলাকায় গিয়ে গত বছর বলেছিলাম থার্ড ইয়ার চলতেছে, এবারও একই উত্তর দিচ্ছি। এর আগেও বেশ কয়েকবার দ্বিতীয় বর্ষের কথা বলেছিলাম। ইদানিং এলাকার মানুষেরা বলতেছে- রিটেক বা সেমিস্টার ড্রপ দিয়েছি কিনা? আমি উত্তর দিতে পারিনি। মোটামুটি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হইনা। দ্রুত ছুটি শেষ হোক!
ঘটনা প্রবাহ-০২ঃ সবাই নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছেন। ২১-২৪ ব্যাচের প্রায় সবাই খুশি। ২৫ দিনের টানা ছুটি। জিয়া হলের মসজিদে নামাজি শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন হাতেগোনা কয়েকজন। নামাজ শেষে ২০ ব্যাচের শাহিন (ছদ্মনাম) নিরবে কান্না করছেন। বিষয়টি প্রতিবেদকের নিকট খটকা লাগলে পরে একান্ত আলাপচারিতায় উদ্ঘাটন হয় কান্নার পেছনের গল্পটি। ঈদের ছুটিতে যাতায়াত খরচ প্রায় ২৫০০ টাকা বহন করা সম্ভব নয় বিধায় বাড়ি যেতে পারবেনা এই ঈদে।
ঘটনা প্রবাহ-০৩ঃ আমি মনির, প্রায় সবাই ঈদে বাড়ি চলে গেছে। হল ফাঁকা। আমি রিডিং রুমে বসে আছি। পড়তে ইচ্ছে করছেনা। সবাই বাড়ি গিয়ে কত্ত মজা করছে! আমি পারছিনা! বাড়ি গেলেই এলাকার মানুষেরা বলে বাড়িতে ভাত পায়না, এতো পড়ে কি হবে? এর চেয়ে কাজ করলে ভাতের কষ্ট থাকেনা। বিদেশ গেলে মাসে লাখ লাখ টাকা আসতো। তাদের কথা সত্য। অনেকেই কাজকর্ম করে বাড়ি ঘর গাড়ি করে ফেলছে। এই কথা গুলো শুনলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা। এইজন্য ছুটিতে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না।
ঘটনাপ্রবাহ-০৪ঃ আমি পলাশ, আমার কাঁধে দুনিয়ার বোঝা। পরিবারে অসুস্থ বাবা মায়ের জন্য আমার নিরন্তর ছুটে চলা। মাসিক খরচ দিতে হয় বাড়িতে। ঈদে বাড়ি না গিয়ে দিনাজপুর থাকলে বাড়তি কিছু টাকা আয় হবে। যা দিয়ে পরবর্তীতে সেমিস্টার ফি প্রদান সহ অন্যান্য খরচ বহন করা যাবে। তাই আমি এবার ঈদে বাড়ি যাবোনা।
ঘটনা প্রবাহ-০৫ঃ আমি শিশির, গত দুই বছর ধরে এলাকায় আমার সমবয়সী কিংবা ছোটদের বিয়ের দাওয়াত খেয়ে বেড়াচ্ছি। তারা সবাই কোনো না কোনো কাজ করে। আর আমি এখনো পড়াশোনা করেই যাচ্ছি। এলাকার মানুষেরা দেখা হলেই বলে বিয়ে কবে করবো? এই যন্ত্রণায় আর বের হইনা বাড়ি থেকে।
ঘটনা প্রবাহ-০৬ঃ আমি মার্জিয়া- বাড়ি গেলেই কিভাবে যেন পাত্র পক্ষের লোকজন আসে বিয়ের পয়গম্বর নিয়ে। এখন তো ক্যাম্পাস থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পাত্রপক্ষকে দেখায়। মা, খালা, ফুফুরা বলে এখনই বিয়ের সময়, দেরি করলে সমস্যা হবে। কিন্তু আমি পড়তে চাই, স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। এজন্য ছুটিতে বাড়ি যেতে ভয় লাগে, ভালোও লাগেনা। এমনটা আরো অসংখ্য মেয়েদের ক্ষেত্রেই হয়েছে।
ঘটনা প্রবাহ-০৭ঃ আমি জিল্লু, ঈদের পরেই আমার মিড, কুইজ, ফাইনাল পরীক্ষা। বিগত সেমিস্টারে রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। এবার ভালো করতে হবে। ছুটিতে বাড়ি গেলে পড়া হবেনা। তাই ক্যাম্পাসেই থাকবো।
ঘটনা প্রবাহ-০৮ঃ আমি রাবেয়া, অনেকদিন হলো বাড়ি যাইনা। এবার ঈদেও যাবোনা। আমার তো বাবা মা নেই। পরিবারে ভাই ভাবি আছে। তারা আমার খোঁজ নেয়না খুব একটা। বরং বাড়ি গেলে অশান্তি শুরু হয়। এখানেই ভালো আছি, ভালো থাকি। একা একা থাকতে হবে ক'টাদিন, এই আর কি!!
ঘটনা প্রবাহ-০৯ঃ আমি রিয়াদ, এলাকায় রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় থেকে আর বাড়ি যেতে পারিনা। আমি কখনো কারো ক্ষতি করিনি। কিন্তু ট্যাগ থাকায় হাজারো কথা শুনতে হয়। এজন্য ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবোনা।
ঘটনা প্রবাহ-১০ঃ আমি দিপু, আমি জন্ম থেকেই বাপ দাদার ভিটে তে দুদিনের বেশি থাকিনি। বাবার চাকরি সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি। গ্রামের কাউকে চিনি না আমি। গিয়ে একা থাকতে হবে ভেবে গ্রামে যাইনা। বাবা যেখানে এখন চাকরি করে সেখানেও ভালো লাগেনা। এজন্য দিনাজপুরই থেকে যাবো। আর তো ক'টা দিন।
এমআই