নুসরাত নাঈম সাজিয়া, রাজশাহী কলেজ প্রতিনিধি:
ঋতুরাজ বসন্ত বিদায় নিয়েছে,তাপদাহ গ্রীষ্মের রোদের তীব্রতা জানান দিয়েছে নববর্ষের। বৈশাখের তপ্ত হাওয়ায় একটুকু প্রশান্তি নিয়ে নয়নাভিরাম রক্তরাঙা কৃষ্ণচূড়া আর জারুলের তুর্কী রঙের ফুলের মায়ায় জড়িয়েছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের পটভূমিতে সমৃদ্ধ বিদ্যাপিঠ দেশ সেরা রাজাশাহী কলেজ। এ যেন এক জারুল-কৃষ্ণচূড়ার ক্যাম্পাস।
গ্রীষ্মের শুরুতেই পুরো ক্যাম্পাসে দৃষ্টিনন্দন কৃষ্ণচূড়ার লাল আভার মুগ্ধতা ছড়াতে শুরু করে। সূর্যের সবটুকু উত্তাপ যেন কেড়ে নিয়েছে টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়া।আর প্রচণ্ড খরতাপের মাঝে শান্তির পরশ বোলানো বেগুনি রঙের বিচ্ছুরণ ছড়াচ্ছে জারুল ফুল।
মনভোলানো রং আর রূপের বাহার ছড়ানো অপরূপ বর্ণিল সাজের এই ফুলগুলো তাপদাহে ক্লান্ত পথিকের গতি শ্লথ করে দেয়। ক্ষণিকের জন্য ছুটে নিয়ে যায় প্রকৃতির সন্নিকটে।সবুজরঙা প্রকৃতির আবৃত ক্যাম্পাসে রঙে-সৌন্দর্যে একে অপরকে মাত দিতে জারুল-কৃষ্ণচূড়া দুটি ফুলই প্রস্ফুটিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে ক্যাম্পাসজুড়ে।
একদিকে জারুল ফুল স্ব-মহিমায় রাজশাহী কলেজের সৌন্দর্যে এক মিষ্টি অধ্যায় যোগ করেছে।বৈশাখের রুদ্ররূপ ঝেড়ে ফেলে কলেজের সবুজ গালিচা ভেদ করে মাথা তুলেছে বেগুনী রঙের জারুল ফুলের পাঁপড়ি।কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান ভবন ও পরিসংখ্যান বিভাগের সামনে সবুজ পাতার ক্যানভাসে বেগুনি জারুল ফুটিয়ে তুলেছে হাস্যোজ্জ্বল প্রকৃতি। রঙ আর রূপের বাহার ছড়ানো অপরূপ বর্ণিল সাজের এই ফুল সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে বসে। এছাড়াও ক্যাম্পাসের পেন্সিল কর্নারে শোভা পাছে বেগুনি আভার জারুল ফুল। তার মাঝেই আবার উঁকিঝুঁকি মারছে হলুদ পরাগ।সবুজ পাতা, হালকা বাদামি বর্ণের বাকল আর ছয়টি মুক্ত পাঁপড়িতে গঠিত ও হলুদ রঙের পরাগবিশিষ্ট মায়াবি জারুলের এই মোহনীয় ছোঁয়ায় রাজশাহী কলেজের প্রকৃতি সেজেছে তার আপন মহিমায়।
যেই রঙে মুগ্ধ হয়ে কবি আহসান হাবীব তার 'স্বদেশ' কবিতায় জারুলের বন্দনা করেছেন ঠিক এভাবে-
"মনের মধ্যে যখন খুশি, এই ছবিটি আঁকি, এক পাশে তার জারুল গাছে, দুটি হলুদ পাখি।"
শুধু আহসান হাবীবই নয়; ‘রুপসী বাংলার কবি’ জীবনানন্দ দাশও জারুলের শৈল্পিক রূপের অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন কবিতায়।জীবনানন্দ দাশই একমাত্র কবি, যিনি কবিতায় জারুল ফুলের সৌন্দর্যকে অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে বর্ণনা করে বলেছেন - ‘ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর-চিল একা নদীটির পাশে/ জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে।’
জারুল ফুল কে বলা হয় বাংলার চেরিফুল।এর ইংরেজি নাম Giant crape-myrtl;বৈজ্ঞানিক নাম Lagerstroemia Speciosa। Lythraceae পরিবারভুক্ত মাঝারি আকৃতির ফুলগাছটি ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। নিম্নাঞ্চলের জলাভূমিতে গাছটি ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে। তবে শুষ্ক অঞ্চলেও এদের দেখা যায়। শীতে এই নয়নাভিরাম গাছটি পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। তবে বসন্তের শুরুতেই গাঢ় সবুজ পত্রপল্লবে ফিরে পায় তার নিজস্বতা। এর লম্বাটে পাতাগুলো পত্রদণ্ডের বিপরীতে সাজানো থাকে।গ্রীষ্মের শুরুতেই থোকায় থোকায় প্রস্ফুটিত হয় বেগুনি রঙের ফুল। গ্রীষ্মে ফুটলেও শরৎ পর্যন্ত দেখা যায় ফুলটি।
অপরদিকে রৌদ্রস্নাত কৃষ্ণচূড়ার রুপের বর্ণনা করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ‘গন্ধে উদাস হওয়ার মতো উড়ে/ তোমার উত্তরী কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরি।’
কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের সামনের গাছে আগুন রাঙা কৃষ্ণচূড়া ফুল প্রকৃতির সব রঙকে ম্লান করে দিয়েছে। সকালের দিকে ক্যাম্পাসের পিচঢালা কৃষ্ণ বর্ণ রাস্তাগুলো কৃষ্ণচূড়ার ঝরে পড়া রক্ত লাল পাপড়ি যেন পুষ্প শয্যা মনে হয়।
সবুজ কিচিমিচির পাতা-ভর্তি গাছে লাল কৃষ্ণচূড়া যেন অপার্থিব এক সৌন্দর্য। এছাড়া কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, রবীন্দ্র-নজরুল চত্বর, কলাভবন, ফুলার ভবন এবং রসায়ন ভবনের সামনে রয়েছে রক্তবর্ণ এই ফুলের রঙিন সমাহার। পুরো কলেজ ক্যাম্পাস যেন কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্যে শোভিত। কৃষ্ণচুড়া ফুল কার না প্রিয়। কত গান, কবিতা এই কৃষ্ণচুড়াকে ঘিরে। সবুজ পাতায় ঘেরা এই ফুলের লাল রং সবাইকে মাত করে রাখে।
বাংলার রক্তের ইতিহাসে রাজশাহী কলেজের ত্যাগ ও গৌরবময় অবদানের সাক্ষীর প্রতিচ্ছবি রক্তবর্ণের কৃষ্ণচূড়া।এর ইংরেজি নাম ফ্লেম ট্রি;বৈজ্ঞানিক নাম ‘ডেলোনিক্স রেজিয়া’। এটি ফ্যাবেসি পরিবারের অন্তর্গত একটি বৃক্ষ যা গুলমোহর নামেও পরিচিত। আমাদের দেশে লাল এবং হলুদ রঙের ফুল দেখা গেলেও সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়ার দেখা কালেভদ্রে দেখা যায়।কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদ উচ্চতায় ১২-১৪ মিটার হলেও শাখা-পল্লবে এটি বেশি অঞ্চলব্যাপী ছড়িয়ে পরে। শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ। কৃষ্ণচূড়ার জন্মানোর জন্য উষ্ণ বা প্রায়-উষ্ণ আবহাওয়ার প্রয়োজন হয়।
ফুলের পরিপূরক যে আর কিছু নেই কবির ভাষায় তা স্পষ্ট বারংবার।সবুজ পত্রপল্লবের ফাঁকে ফাঁকে শাখায় শাখায় জারুল-কৃষ্ণচূড়ার উচ্ছলতায় রাজশাহী কলেজ সেজেছে বৈশাখের রঙিন সাজে। শীত-বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের খরতাপের মাঝেও জারুল-কৃষ্ণচূড়ার মায়াবী উপস্থিতি মনভোলানো আআহ সৃষ্টি করেছে।জারুল-পলাশের ছায়ায় বসে চলে শিক্ষার্থীদের আড্ডা-গিটারের টুংটাং আওয়াজে,গানের সুরে কেউবা আবৃত্তি করছে।অনেকেই গাছের ছায়ায় বসে বই সামনে নিয়ে বিভোর স্বপ্নে গুনছেন রঙিন এক ভবিষ্যৎ।সবমিলিয়ে নয়নাভরণ্যে আবৃত ক্যাম্পাসটির অপরুপ সৌন্দর্যে জারুল-কৃষ্ণচূড়া যোগ করেছে নতুন উচ্ছ্বাসের মাত্রা।
এমআই