নিজস্ব প্রতিবেদক:
সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যেই পাকিস্তানকে প্রকাশ্য সমর্থন দেওয়ায় ভারতজুড়ে তুরস্ক বয়কটের ডাক জোড়ালো হচ্ছে। শুরুতে ভারতীয়দের মধ্যে শুধু ভ্রমণ বয়কটের ডাক উঠলেও, এখন তা তুর্কি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দিকে এগিয়েছে। খবর বিবিসি'র।
বৃহস্পতিবার (১৫ মে) জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভারতের বিমানবন্দরগুলোতে তুরস্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেলেবি-র কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং মওলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু ইউনিভার্সিটির মতো ভারতের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই তুরস্কের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অ্যাকাডেমিক সম্পর্ক স্থগিত করেছে।
দিল্লি ও মুম্বাইয়ের মতো বড় বড় বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিষেবা প্রদানকারী সেলেবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে।
ভারতের বেসামরিক বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'এক্স'-এ এক পোস্টে জানান, সম্প্রতি সেলেবিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে দেশজুড়ে বিভিন্ন আবেদন জমা পড়েছে।
তিনি লেখেন, 'বিষয়টির গুরুত্ব ও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় এসব আবেদন আমলে নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিল করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়।'
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেলেবি কর্তৃপক্ষ অভিযোগগুলো 'স্পষ্ট' করতে এবং আদেশ প্রত্যাহারের জন্য সব ধরনের 'প্রশাসনিক ও আইনি' পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে। নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিলের ঘটনাকে তারা 'অন্যায়' বলেও আখ্যায়িত করেছে।
সেলেবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, 'ভারতের বিমানবন্দর পরিচালনা কিংবা বেসামরিক বিমান চলাচলে যেকোনো সম্ভাব্য বিঘ্ন, বিলম্ব বা নেতিবাচক প্রভাবের জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠান বা এর কোনো সহযোগী সংস্থা দায়ী নয়।'
গত সপ্তাহে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে প্রাণঘাতী হামলার জবাবে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায় দিল্লি। এরপর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। পাকিস্তান ওই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ভারতের সামরিক অভিযানের পর তুরস্ক ও আজারবাইজান দ্রুত পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। আঙ্কারা আশঙ্কা প্রকাশ করে, 'পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ' ছড়িয়ে পড়তে পারে। অন্যদিকে বাকু ভারতের বিমান হামলার নিন্দা জানায়।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয়দের মধ্যে তুরস্ক ও আজারবাইজানের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুই দেশের পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বয়কটের ডাক জোরালো হয়। এতে জড়িয়ে পড়েন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও।
পাকিস্তানের হামলায় তুরস্কের ড্রোন ব্যবহারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এই বয়কট আন্দোলন আরও গতি পায়।
ভারতের শাসক দল বিজেপির নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর বলেন, 'বিদেশে পর্যটক হিসেবে যাত্রা করা প্রত্যেক পরিশ্রমী ভারতীয় আজ বুঝতে পারছে, তার কষ্টার্জিত রুপি এমন কারও পেছনে খরচ হওয়া উচিত নয়, যারা আমাদের দেশের শত্রুদের সহযোগিতা করে।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়কটের ডাক তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলেছে। ভারতীয় ট্রাভেল সাইটগুলো জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই বুকিং বাতিলের হার হঠাৎ বেড়ে গেছে।
ট্রাভেল সাইট মেকমাইট্রিপ-এর একজন মুখপাত্র জানান, 'গত এক সপ্তাহে ভারতীয় পর্যটকদের আবেগ তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আজারবাইজান ও তুরস্কগামী বুকিং ৬০ শতাংশ কমেছে, আর বাতিলের হার ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।'
বেশিরভাগ ট্রাভেল সাইট এখনো বুকিং চালু রেখেছে। তবে কেউ কেউ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করছে—চুপিসারে তুরস্ক ও আজারবাইজানের জন্য প্রচারণা ও ফ্লাইট ছাড় প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
দিল্লির এক ট্রাভেল এজেন্সির মালিক রোহিত খাট্টার বলেন, তুরস্ক সফর নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে ইতোমধ্যেই দ্বিধা দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, 'অনেক তরুণ পর্যটক হয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কিংবা সামাজিক প্রতিকূলতার ভয়ে তুরস্ক এড়িয়ে চলবে।' তিনি আরও জানান, তার সংস্থা এমন সফরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়, যা আদৌ বাস্তবায়িত না-ও হতে পারে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৩ লাখ ৩০ হাজার ১০০ জন ভারতীয় তুরস্ক সফর করেছেন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার। আজারবাইজানেও ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে; গত বছর সেখানে গেছেন প্রায় ২ লাখ ৪৪ হাজার ভারতীয়।
তবে সংখ্যার দিক থেকে এই বৃদ্ধির পরও, ২০২৪ সালে তুরস্কে বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে ভারতীয়দের অংশ ছিল ১ শতাংশেরও কম। যা দেশটির মোট পর্যটন আয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে না। বিপরীতে, আজারবাইজানে বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে ভারতীয়দের অংশ ছিল প্রায় ৯ শতাংশ।
করোনার পর তুরস্ক ও আজারবাইজান ভারতীয় পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ হিসেবে রয়েছে ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার স্বাদ, ভৌগোলিক নৈকট্য এবং সাশ্রয়ী খরচ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট এয়ারলাইনের সরাসরি ফ্লাইট চালু হওয়ায় এসব গন্তব্যে যাতায়াত আরও সহজ হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ বিকল্প গন্তব্য হিসেবে গ্রিসের প্রচার করছেন। তবে ট্রাভেল সাইটগুলোর ভাষ্য, এসব গন্তব্য নিয়ে আগ্রহে এখনও বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।
ট্রাভেল সাইট ক্লিয়ারট্রিপ বিবিসিকে জানিয়েছে, 'এটি এখনো একটি চলমান পরিস্থিতি। তাই বিকল্প গন্তব্যগুলোর চাহিদায় এখনও তেমন কোনো বড় উত্থান বা পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।'