রবিবার, ১৮ মে ২০২৫

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব

শনিবার, মে ১৭, ২০২৫
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব

প্রফেসর ড. এস. কে. আকরাম আলী:

দ্বন্দ্ব আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এবং আমরা প্রায়শই তা সমাজে ও জাতীয় জীবনে প্রত্যক্ষ করি। বাংলাদেশ সমাজ এর ব্যতিক্রম নয়, এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার শুরু থেকেই আমরা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ভুগে আসছি। স্বাধীনতার পরপরই সমাজে বিভাজনের বীজ বপন করা হয় এবং ঐক্যের পরিবর্তে সমাজকে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত করা হয়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং এর সর্বোচ্চ নেতা শেখ মুজিব তা করেন ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে। জনসাধারণকে বিভক্ত করা হয় মুক্তিযুদ্ধপন্থী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দুই ভাগে, এবং আজও জাতি এই বিভাজনের অভিশাপে ভুগছে।

এই বিভাজন আরও চরম আকার ধারণ করে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার শাসনামলে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সামাজিক অবিচারের শিকার হন, যেখানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। শেখ মুজিব ও তার কন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলে জনগণ নিজেদের নেতাদের কাছ থেকেই চরম প্রতারণার শিকার হন।

রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় বাংলাদেশের জন্মের আগেই। পণ্ডিতগণ লক্ষ্য করেন, পূর্ব স্বাধীনতার সময় থেকেই আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভাজন ছিল। এক দল ছিলেন শেখ মুজিব, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর নেতৃত্বে — যাদেরকে ডানপন্থী বলে গণ্য করা হতো। অপরপক্ষে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, আব্দুস সামাদ আজাদ, ফণিভূষণ মজুমদার, মনোরঞ্জন ধর ও আবদুর রাজ্জাক — এরা ছিলেন বামপন্থী।

ছাত্রলীগ, যা দলের পেশিশক্তি হিসেবে বিবেচিত, সেটিও বিভক্ত হয়ে যায়। এ এস এম আবদুর রব (ডাকসুর ভিপি) ও শাহজাহান সিরাজ (ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক) নেতৃত্ব দিতেন র‍্যাডিক্যাল গ্রুপকে, আর তাদের দর্শনীয় ও তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তারা ভারতের ও মস্কোর সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। অন্যদিকে, নূরে আলম সিদ্দিকী (ছাত্রলীগ সভাপতি), আবদুল কুদ্দুস মাখন (ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক) এবং তোফায়েল আহমেদ নেতৃত্ব দিতেন উদারপন্থী গোষ্ঠীকে। তারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিলেন, স্বাধীনতায় নয়। এক সংগঠনের মধ্যে এই দুই দল ছিল ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচির অধিকারী।

বাংলাদেশের জন্ম সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের র‍্যাডিক্যাল গ্রুপের যৌথ প্রচেষ্টায়, তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন উদারপন্থী দলটি কোণঠাসা হয়ে পড়ে, কারণ ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তবে শেখ মুজিব ফিরে আসার পর দ্রুত আবার নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন এবং প্রথম কাজ হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন।

কিন্তু প্রশাসনে শেখ মুজিব ব্যর্থ প্রমাণিত হন এবং এর ফলস্বরূপ ১৯৭৪ সালে দেশ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করে, যেখানে কয়েক লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। যখন শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক ধারা থেকে সরে গিয়ে একদলীয় শাসন কায়েম করেন, তখন এতে বিরক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র (যাঁরা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন) এবং দলের ডানপন্থী গোষ্ঠী। এরই পরিণতি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের করুণ পরিণতির মাধ্যমে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্র পরিবর্তিত হয় জিয়াউর রহমানের উত্থানে। তিনি ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর ঘোষণা দিয়ে জাতিকে একত্রিত করতে সক্ষম হন। একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিএনপি গঠিত হয়।

মওলানা ভাসানীর ন্যাপের মতো তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলগুলোর নেতা মশিউর রহমান নিজ দল ছেড়ে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগ দেন। মশিউরের মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমান একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের খোঁজে শাহ আজিজুর রহমানকে বেছে নেন, যিনি ছিলেন মুসলিম লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাংসদ। এভাবে বিএনপি গঠিত হয় ন্যাপ ও মুসলিম লীগের সমন্বয়ে — এক ধরনের ডান ও বাম রাজনীতির ঐক্য ঘটে।

যদিও দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব ছিল, তা কখনো দলের জন্য বড় প্রতিবন্ধক হয়নি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় — যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিস্ময়কর ঘটনা। কেন বিএনপি এত জনপ্রিয় তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। এর পেছনে তিনটি বড় কারণ থাকতে পারে:
১. দলের কাছে কিছু রাজনৈতিকভাবে প্রজ্ঞাবান নেতা ছিলেন,
২. প্রতিষ্ঠাতার পথ অনুসরণ করা,
৩. খালেদা জিয়ার আপসহীন গণতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব।

গত পনেরো বছর শেখ হাসিনার অত্যাচারী শাসনে বিএনপি অগণিত নিপীড়নের শিকার হয়, কিন্তু তারা রাজনীতি ছাড়েনি। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তারা অগ্রগতি করতে পারেনি এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্যাতনে ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে তারা কিছুটা সংশয়ে পড়ে। তবু তারা লড়াই চালিয়ে যায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এবং কঠিন পরীক্ষাগুলোতে ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয় — একটি প্রকৃত জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে।

সাম্প্রতিক বিপ্লবের পর জনমানসে তাদের সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, যা কাম্য নয়। বিএনপির নেতৃত্বকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে পছন্দের লোক বেছে নেওয়া ও স্বজনপ্রীতি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এবং গত ৪৬ বছরে গড়ে ওঠা আস্থা মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রতিষ্ঠাতা ও তাঁর যোগ্য উত্তরসূরির নীতি থেকে বিচ্যুতি দল ও জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। সঠিক মনোভাবই দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফলাফল আনে, সস্তা জনপ্রিয়তা নয়।

জামায়াতে ইসলামি একটি ইসলামি আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তারা এখন পর্যন্ত তাদের অঙ্গীকারে অবিচল থেকেছে। তবে প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জন করতে না পারার কারণ একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি প্রতিশ্রুতিশীল দল যদি প্রতিনিয়ত কৌশল পরিবর্তন করে তাৎক্ষণিক লাভের আশায়, তাহলে তা অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

যদিও এখনো জামায়াতের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব দেখা যায়নি, তবে সমাজে ধারণা তৈরি হয়েছে যে তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অস্থির। এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি না করে ভবিষ্যতে এমন আলোচনায় যাওয়া উচিত নয়। সফলতার জন্য এখনো মাঠ প্রস্তুত হয়নি — এ জন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। তাদের উচিত আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যাওয়া। ইনশাআল্লাহ বিজয় আসবে।

নবগঠিত এনসিপি (NCP)-কে জনগণ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। জুলাই বিপ্লব ২০২৪-এ তাদের অবদান জাতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। তবে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন না করে তারা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসতে পারে এমন কোনো দলে যোগ দিতে পারত।

রাজনীতি বিশ্বব্যাপী জটিল বিষয় এবং এতে অভিজ্ঞ ও পরিপক্ব নেতৃত্বের প্রয়োজন। ছাত্রনেতারা এখন পর্যন্ত অপরিপক্ব এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সাক্ষাতের পর দুই নেতার ভিন্নমত প্রকাশ করে রাজনৈতিক অপরিপক্বতা প্রমাণ করে। এক উপদেষ্টার সময়ে সময়ে দেয়া বিবৃতি জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং ভুল বার্তা দেয়। বোতল বিতর্ক তার ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং প্রজ্ঞার অভাব ফুটে উঠেছে।

জামায়াতে ইসলামি ও বিএনপির মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব জাতি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে সংঘর্ষ জাতির উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। জনগণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা প্রত্যাশা করে, দ্বন্দ্ব নয়—এবং ভবিষ্যতের নতুন রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও সংস্কৃতির জন্য বিপ্লবের অংশীজনদের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রত্যাশা করে।

জেনারেল ওয়াকারুজ্জামানের অবদান জাতি প্রশংসা করেছে এবং এই সংকটকালে ড. ইউনূসের ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে বিদেশ থেকে পরিচালিত কিছু মাধ্যম তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে বলে গুজব ছড়াচ্ছে, যার কোনো প্রমাণ নেই। এটি জাতির জন্য বিপজ্জনক, যখন আমরা অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছি। এ ধরনের গুজব ছড়ানো থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। সেনাপ্রধান ও ড. ইউনূসের সম্পর্ক অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং তাঁরা উভয়েই দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন।

শেষ কথা, উপদেষ্টাদের বিবৃতিগুলো অনেক সময় মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা দেয় এবং মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভ্রান্ত হয়। আপনি জাতির তত্ত্বাবধায়ক, তাহলে আপনি কেন মানুষকে বলছেন দেশ রক্ষা করতে? বরং আমরা চাই, আপনি আমাদের দেশ ও জাতিকে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করুন — আর আমাদের আপনার উপর পূর্ণ আস্থা আছে।

এমআই


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল