নুসরাত নাঈম সাজিয়া, রাজশাহী কলেজ প্রতিনিধি:
রাজশাহী কলেজ বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কলেজটিতে রয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বহু নিদর্শনের ছাপ।যার মধ্যে বিশেষ এক সম্পদ ছিল এই কলেজের জাদুঘর বা সংগ্রহশালা, কালের বিবর্তনে এখন যা অযত্ন,অবহেলায়, অবমূল্যায়নে শতবর্ষ ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। যার ফলে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গৌরবময় অতীতের গল্প অগ্রযাত্রার বিপরীতে ধুলো ও মাকড়সার জালে চাপা পড়ে আজ বিলুপ্তপ্রায়।
জাদুঘরটি একটি কলেজেরই একটি এককক্ষবিশিষ্ট ঘরজুড়ে রয়েছে, যা অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরই কাছেই অজানা।প্রশাসনের কাছে একাধিকবার আবেদন জানানো হয়,বারবার আবেদনের প্রেক্ষিতে অবেশেষে খোলা হয় কলেজের ঐতিহ্যের ধারক জাদুঘরের কক্ষটি।
আবেদনের প্রায় দশ-বারো দিন অপেক্ষার পর সাংবাদিকদের সামনে এক দুপুরে খোলা হয় রহস্যময় কক্ষের তালা।স্পষ্টতই এতদিন অপেক্ষা করিয়ে জাদুঘর খোলা হয়েছে মানে,এর তালা খোলার আগেই সেটি পরিষ্কার করা হয়েছে।তবুও অবমূল্যায়নের ছাপ যেন স্পষ্ট জাদুঘরের প্রতিটি কোণায় কোণায়।
জাদুঘরে ঢুকতে প্রথমেই চোখ পড়ে দেয়ালে নামহীন,সালবিহীন ধুলোমাখা ছবির উপর। যেখানে -সেখানে অযত্নে পড়ে রয়েছে ধুলোমাখা ছিন্নপ্রায় ফাইলে বন্দি পুরনো সব বই,নথি-পত্র। জাদুঘরটিতে রয়েছে অনেক দেশি-বিদেশি মনীষীদের প্রতিকৃতি যা অনেক কাল ধরেই শিক্ষার্থীদের অজানা।এছাড়া রয়েছে পুরোনো দিনের কাঠের আলমারি, ব্রিটিশ আমলের টেবিল ফ্যান, ধুলোমাখা বিভিন্ন প্রকারের মাইক্রোস্কোপ।রয়েছে প্রাচীন ঘড়ি, রেডিও, আয়না, ঝাড়বাতির মতো প্রাচীন সব নিদর্শন।এমনকি এখানে আছে একটি প্রিন্টিং মেশিন,এত মূল্যবান বস্তু, মূল্যহীন অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুর মতো ধুলোর আস্তরণের নিচে যেন তার ঠাঁই।
জাদুঘরে থাকা উল্লেখযোগ্য কিছু নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে,ব্রিটিশ আমলের ৮টি ঘড়ি,৩টি রেডিও ও আয়না,২টি পুরস্কার মেডেল,৩৪টি কাঠের ওপর ছাপা ঐতিহ্যের ছবি,২টি মাইক্রোস্কোপ ও ৬টি বিজ্ঞান যন্ত্র প্রাচীন বই, প্রিন্টিং অলমেট ও শিক্ষকদের ওনারবোর্ড। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ঐতিহাসিক এসব সম্পদের সংরক্ষণের জন্য নেই যথোপযোগী কোনো উদ্যোগ। এমনকি এই কলেজের লাইব্রেরিয়ান পর্যন্ত এত বছরের পুরোনো জাদুঘরটির অস্তিত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত।
জাদুঘরটি সম্পর্কে কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া ফেরদৌসের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি এক রাশ বিস্ময় ও কৌতূহলী চোখে প্রশ্ন করেন, 'রাজশাহী কলেজে কি সত্যিই জাদুঘর আছে?' তিনি জানান, জাদুঘর সম্পর্কে তিনি একান্তই অজ্ঞ ছিলেন।
বলা যায়,রাজশাহী কলেজের এই জাদুঘরের বিষয়ে সব শিক্ষার্থীরাই সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞাত।
কলেজের আরেক শিক্ষার্থী আব্দুস সামাদ বলেন, 'রাজশাহী কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার প্রবলআগ্রহ থাকলেও আমরা সেভাবে জানতে পারিনি কিছুই।হয়তো আমাদের তা জানতে দেয়া হয়নি।
কলেজের বিভিন্ন শিক্ষকদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে একই ধারার বিস্ময়।তারা জানান যে শ্রেণিকক্ষে ইতিহাসচর্চা তেমন একটা হয় না, যদিও লাইব্রেরিতে এ সংক্রান্ত কিছু বইপত্র রয়েছে।
এখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি, রাজশাহী কলেজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে এই জাদুঘরকে পুনরুজ্জীবিত করা, শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা এবং আধুনিক সংরক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী কলেজ শিক্ষার্থী বায়জিদ সরকার বলেন, 'কলেজের জাদুঘরটি অনতিবিলম্বে সংস্কার করে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হোক।অন্যথায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক শতবর্ষী এই নিদর্শনগুলোর অবলুপ্তি আমাদের সাংস্কৃতিক দেউলিয়ার প্রকাট্য দলিল হয়ে থাকবে।'
সত্যি বলতে এরকম একটি সুমহান ও ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাদুঘর যা এমন গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা,সেটি বছরের পর বছর তালাবদ্ধ ও অবহেলিত থাকা কেবল দুঃখজনকই নয়,লজ্জারও।এটি রাহশাহী কলেজের প্রশাসনিক গাফিলতির স্পষ্ট উদাহরণ।কেবলমাত্র অবহেলার চরম আর সঠিক পন্থায় সংরক্ষণের অভাবে কালের ঐতিহ্যের বাহক মূল্যবান এই দলিলগুলো এখন ধ্বংসপ্রায়।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে যে রাজশাহী কলেজের মতো দেশসেরা একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান,এর ইতিহাস বিজরিত জাদুঘর কেন এভাবে অবহেলায়-অযত্নে পড়ে থাকবে আর কেনইবা এই জাদুঘরটি সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জানার বাইরে রয়েছে। কলেজ প্রশাসনকে এই প্রশ্নগুলো করেন একজন সাংস্কৃতিক কর্মী, অলিউর রহমান বাবু,তিনি বলেন, কলেজের জাদুঘর কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য,জাদুঘর এই কলেজের একটি ঐতিহ্য ও কালের নিদর্শন আর এটিকে অবমূল্যায়ন করে প্রশাসন তাদের চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মু. যহুর আলী বলেন, জাদুঘরের উন্নয়ন সম্পর্কে আমাদের এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম করা হয়নি।বর্তমানে জাদুঘরের গুরুত্ব সম্পর্কে যারা অবহিত তাদের ও সরকারের সহায়তা থাকলে জাদুঘরের উন্নয়ন করা সম্ভব।'