মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন, হাবিপ্রবি:
হাজী মোহাম্মদ দানেশ (২৭ জুন ১৯০০-২৮ জুন ১৯৮৬), কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তনে, মেহনতি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখে যাওয়া এক ত্যাগী মানুষের নাম। কৃষক যেন তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায়সংগত ভাগ পান, এজন্য নিরলস সংগ্রাম করেন। জোতদার পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি হন কৃষকের নয়নমণি। আচ ২৭ জুন ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী ও আগামীকাল ২৮ জুন তার ৩৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ থানার সুলতানপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে তিনি ১৯৩১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩২ সালে তিনি আইনে ডিগ্রি লাভ করেন এবং দিনাজপুর জেলা আদালত বার-এ যোগ দেন। হাজী মোহাম্মদ দানেশ অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের একজন কৃষক নেতা যিনি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাকে তেভাগা আন্দোলনের ‘জনক’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হাজী দানেশ রাজনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখার জন্য ১৯৮৩ সালে দৈনিক তিস্তা পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। এরশাদ সরকারের শাসনামলে তার সম্মানে দিনাজপুর কৃষি কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল ‘হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি মহাবিদ্যালয়’। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে এ মহাবিদ্যালয়কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। নাম রাখা হয় হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তার নামে বোচাগঞ্জের সুলতানপুরে একটি উচ্চবিদ্যালয়, এতিমখানা এবং ঠাকুরগাঁও শহরেও একটি মাদরাসা ও এতিমখানা রয়েছে।
ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে যখন জোতদার-জমিদারদের শোষণ, ইংরেজদের দুঃশাসন আর মহানন্দা নদীর করালগ্রাসে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল, যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধছিল, সে রকম একটি সময়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হজ পালন করেছিলেন মোহাম্মদ দানেশ। সে কারণে তিনি অল্প বয়স থেকে ‘হাজি’ পরিচিতি পেয়েছিলেন। পরে কমিউনিস্ট ধারার রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে কৃষকের ভাগ্যবদলের চেষ্টা করেছিলেন।
৩২ বছর বয়সে হজ পালন করতে গিয়ে হাজি মোহাম্মদ দানেশ সৌদি পুলিশ দ্বারা ভারতীয়দের নানাভাবে নির্যাতিত হতে দেখেন। ১৯৩০ সালে কমিউনিস্ট ভাবধারার রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৩৭ সালে কৃষক সমিতিতে যোগ দিয়ে কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হন। দিনাজপুরে কৃষক সমিতির শাখা গঠন করেন, যার অফিস করা হয় জেলা শহরের মুন্সীপাড়ায়। এ সংগঠনে থেকে তিনি কৃষকদের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে তোলাবাটি আন্দোলন ও সুদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলে বিজয় লাভ করেন। এভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে কৃষকের পক্ষে, দরিদ্র মানুষের পক্ষে গড়ে ওঠা আন্দোলনের নেতৃত্বে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। তার নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়।
ব্রিটিশ শাসনের শেষপর্যায়ে দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন গড়ে ওঠে কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে। দিনাজপুর থেকে শুরু হওয়া তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ ও কমরেড গুরুদাস তালুকদার। এ আন্দোলন ১৯টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। হাজী দানেশের বলিষ্ঠ রাজনীতি ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তাই ইংরেজ সরকার ১৯৩৮ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে। বেশ কিছুদিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়।
হাজী দানেশ ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্বদান অব্যাহত রাখার কারণে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৫৭ সালে গণতন্ত্রী দল বিলোপ করে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং দলের সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন এবং ভারতের মাটিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পুরো সময় কাজ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে (বাকশাল) যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। বাকশাল সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে তিনি জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন পুনরুজ্জীবিত করেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে এ দল বিলোপ করে হাজী দানেশ গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। হাজী দানেশ জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় কৃষক পার্টির প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি দিনাজপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। রাজনীতিতে একটি বিরাট কর্মময় জীবনের ইতিহাস রেখে হাজী দানেশ ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন ভোর ৪টা ২৫ মিনিটে ঢাকা পিজি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তাকে দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ ময়দানে মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।
প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী, সাধারণ মানুষেরা কোনো না কোনো ভাবে স্মরণ করছেন দিনাজপুরের এ কৃষক নেতাকে।
এমআই