নিজস্ব প্রতিবেদক
গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও বিতর্কিত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন দেওয়ার অভিযোগে আগের নিবন্ধিত ৯৬টি স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে নতুন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা ২০২৫ অনুযায়ী ভবিষ্যতে এই ধরনের সংস্থাগুলো আর নিবন্ধন পাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) প্রকাশিত নতুন নীতিমালায় এসব তথ্য জানানো হয়। ইসির জনসংযোগ পরিচালক শরিফুল আলম গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, খুব শিগগিরই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে এবং পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধনের নতুন প্রক্রিয়া শুরু করবে ইসি।
নতুন নীতিমালার প্রধান বৈশিষ্ট্য
নতুন নীতিমালায় পর্যবেক্ষক হওয়ার জন্য ন্যূনতম বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ২১ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়িয়ে এইচএসসি বা সমমান করা হয়েছে। নতুন নীতিমালা শুধুমাত্র দেশীয় পর্যবেক্ষকদের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য প্রযোজ্য হবে।
একটি সংস্থা নিবন্ধিত হলে তারা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর মেয়াদে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। সংস্থাগুলো নির্বাচন পূর্বের দিন, নির্বাচনের দিন এবং পরবর্তী দিন—এই তিন দিন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে। আর নির্বাচন শেষে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
পর্যবেক্ষক নিবন্ধনের জন্য ইসি নির্ধারিত সময়সীমা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেবে। এরপর আবেদন যাচাই-বাছাই করে ইসি দৈনিক পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে এবং যে সংস্থার বিষয়ে অভিযোগ থাকবে, সেটি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।
বাতিলের কারণ ও প্রতিক্রিয়া
ইসির এক কর্মকর্তা জানান, গত ৯ মার্চ কমিশন ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা ২০২৫’ চূড়ান্ত করে, যার মাধ্যমে পূর্বের ২০২৩ সালের নীতিমালা বাতিল করা হয় এবং সেই নীতিমালার আওতায় থাকা সকল সংস্থার নিবন্ধন অকার্যকর ঘোষণা করা হয়।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ এ সিদ্ধান্তকে ‘নিবন্ধনের রাজনীতি’ আখ্যা দিয়ে বলেন, "এটা ইসির নিবন্ধনের রাজনীতি। জানিপপসহ বেশ কিছু পর্যবেক্ষক সংস্থা ৩০ বছর ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে আসছে। যারা গত নির্বাচনের আগেও নিবন্ধন পেয়েছিল। তবে গত কমিশন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা ড. আদিলুর রহমান খান শুভ্রের প্রতিষ্ঠান ‘অধিকার’কে নিবন্ধন দেয়নি বা বাতিল করেছে। মূলত এ কারণেই বর্তমান কমিশন সেটাকে জাস্টিফাই করতেই বাকি সব সংস্থার নিবন্ধনও বাতিল করল, এর পেছনে এক ধরনের নিবন্ধনের রাজনীতি কাজ করেছে।
তাঁর মতে, পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের গত তিন নির্বাচনের বিষয় কমিশন যদি আমলে নিয়ে এ ধরনের বিষয় যুক্ত করে তাহলে তা ঠিক হবে না, এ ক্ষেত্রে গত ১২ নির্বাচনের বিষয় বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন’ কথার মধ্যে ফাঁক রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে অনেক অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষককে নির্বাচনের বাইরে রাখার একটা অপচেষ্টা হতে পারে।"
অন্যদিকে, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম এই উদ্যোগকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “যেসব সংস্থা আগের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাদের বাদ দেওয়ার জন্য আমরাও সুপারিশ করেছিলাম।”
তিনি আরও জানান, “বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ‘স্থানীয় পর্যবেক্ষক’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিল কিছু সংস্থা। নীতিমালায় বাধ্যবাধকতা না থাকায় তারা এ সুযোগ নিয়েছিল। নতুন নীতিমালা এ দুর্বলতা দূর করবে।”
ভোটার তালিকায় নতুন সংযোজন
এদিকে, প্রায় ৬০ লাখ নতুন ভোটার তালিকাভুক্ত করতে ‘ভোটার তালিকা (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’-এর খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। বৃহস্পতিবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে বা যৌক্তিক সময়ে’ ১৮ বছর পূর্ণ করা নাগরিকদের ভোটার তালিকায় যুক্ত করার বিধান থাকবে। এ পর্যন্ত প্রতিবছরের ২ জানুয়ারি খসড়া এবং ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করত ইসি। এতে অনেকে নির্বাচনের আগে ভোটার হতে পারতেন না। নতুন আইনে সেই সমস্যা সমাধানের সুযোগ রাখা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন, “এই আইন কার্যকর হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরও লাখো নতুন ভোটার যুক্ত হতে পারবে, যারা এতদিন বাদ পড়তো কেবল জন্মতারিখ অনুযায়ী সময়সীমা না মেলার কারণে।”
একে