ডক্টর আফজালে হোসেন খান: দেশবরেণ্য অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক জনাব আব্দুল্লাহ আল মামুনের জন্মদিন আগামীকাল ১৩ জুলাই। শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আবদুল্লাহ আল মামুন (১৯৪২-২০০৮) নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, অভিনেতা। ১৯৪২ সালের ১৩ জুলাই জামালপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা অধ্যক্ষ আবদুল কুদ্দুস এবং মাতা ফাতেমা খাতুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগ থেকে বিএ অনার্স ও এমএ (১৯৬৪) ডিগ্রি অর্জন করেন।
আবদুল্লাহ আল মামুন একদিকে নিজের রচিত মৌলিক নাটকের নির্দেশনাসহ অভিনয় করেছেন, অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস কৃষ্ণকান্তের উইল ও ঘরে-বাইরের নাট্যরূপ প্রদানের মাধ্যমে তাতে নির্দেশনাসহ অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি উইলিয়ম শেক্সপিয়রের বিশ্ববিখ্যাত নাটক ওথেলো (মুনীর চৌধুরী ও কবীর চৌধুরীকৃত অনুবাদ) এবং আরবুঝভ-এর পুরানো পালা (আনিসুজ্জামান রূপান্তরিত) নাটকের নির্দেশনাসহ অভিনয় করেছেন। একই সঙ্গে অন্যের রচিত ও নির্দেশিত নাটকেও অভিনয় করেছেন। এর বাইরে বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে আবদুল্লাহ আল মামুনের আরেকটি বড় অবদান হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হক রচিত পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় শীর্ষক কাব্যনাটকের নির্দেশনা ও অভিনয়। ১৯৭৬ সালে মঞ্চস্থ এই নাটকটিই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মৌলিক কাব্যনাট্যের প্রযোজনা।
আবদুল্লাহ আল মামুন ছাত্রজীবন থেকেই নাট্য রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর অভিনয় জীবনে চাষী থেকে শুরু করে যুবক, নেতা, সেনাপতি, মাতবার, বাবা, শিক্ষক, ব্যারিস্টার, নায়ক, বাউল, ফকির, হাজী, ব্যাপারী, ব্যবসায়ী, তাতারি ইত্যাদি স্বদেশীয় চরিত্রের পাশাপাশি ওথেলো নাটকে ইয়াগো, আন্তিগোনে নাটকে ক্রেয়ন ইত্যাদি ভিন্নদেশীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। সঙ্গত কারণেই তাঁর নাটকে বাংলাদেশের সমসাময়িক পারিবারিক, সামাজিক ও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিচিত্র পেশাজীবী মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের কথা উঠে এসেছে।
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিপক্ষে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন জীবনভর তাঁর নাট্য রচনা অব্যাহত রাখেন।তাঁর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ও মঞ্চস্থ নাটকগুলোর মধ্যে সুবচন নির্বাসনে (১৯৭৪), এখনও দুঃসময় (১৯৭৫), এবার ধরা দাও (১৯৭৭), শপথ (১৯৭৮), সেনাপতি (১৯৮০), অরক্ষিত মতিঝিল (১৯৮০), ক্রস রোডে ক্রসফায়ার (১৯৮১), শাহজাদীর কালো নেকাব (১৯৮৪), আয়নার বন্ধুর মুখ (১৯৮৩), এখনও ক্রীতদাস (১৯৮৪), তোমরাই (১৯৮৮), দূরপাল্লা (১৯৮৮), তৃতীয় পুরুষ (১৯৮৮), আমাদের সন্তানেরা (১৯৮৮), কোকিলারা (১৯৯০), পথনাটক: উজান পাবন, বিবিসাব ও কুরসী (১৯৯১), দ্যাশের মানুষ (১৯৯৩), স্পর্ধা (১৯৯৬), মেরাজ ফকিরের মা (১৯৯৭), মাইক মাস্টার (১৯৯৭), মেহেরজান আরেকবার (১৯৯৮), জন্মদিন (২০০৬) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত আরো নাটক (প্রস্তাবিত মঞ্চনাটক): নিয়তির পরিহাস (১৯৫৭), বিন্দু বিন্দু রং (১৯৬২), গোলাপ বাগান (২০০২) ইত্যাদি।
টিভি প্রযোজক, চলচ্চিত্রকার, নাট্যশিক্ষক, ঔপন্যাসিক ও সংগঠক হিসেবে তাঁর অসামান্য খ্যাতি রয়েছে। আবদুল্লাহ আল মামুন ৭টি উপন্যাস রচনা ও প্রকাশ করেন, সেগুলো-মানব তোমার সারাজীবন (১৯৮৮), আহ্ দেবদাস (১৯৮৯), তাহাদের যৌবনকাল (১৯৯১), হায় পার্বতী (১৯৯১), এই চুনীলাল (১৯৯৩), গুন্ডাপান্ডার বাবা (১৯৯৩), খলনায়ক (১৯৯৭)। তিনি আমার আমি নামে একটি আত্মচরিত এবং ম্যানহাটান নামে একটি ভ্রমণ কাহিনী রচনা করেন। তাছাড়া নাট্যাভিনেতাদের জন্য তাঁর অভিনয় (প্রথমখন্ড) নামে একটি শিক্ষামূলকগ্রন্থ রয়েছে।
বাংলাদেশে টেলিভিশনে আব্দুল্লাহ আল মামুনই প্রথম ধারাবাহিক নাটক পরিচালনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য টেলিভিশন ধারাবাহিক প্রযোজনা হলো- সংশপ্তক (২৬ পর্ব), ঘরোয়া (৫২ পর্ব), আমি তুমি সে (২৬ পর্ব), পাথর সময় (১৩ পর্ব), জোয়ার ভাটা (২০০ পর্ব), বাবা (২০০ পর্ব), শীর্ষবিন্দু (৭ পর্ব), জীবন ছবি (১৪ পর্ব), উত্তরাধিকার (১৪ পর্ব) ইত্যাদি।
চলচ্চিত্র পরিচালনাতেও আবদুল্লাহ আল মামুন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের সুস্থধারার শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র পরিচালনায় জীবনের শেষ পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তাঁর পরিচালিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র- সারেং বউ, সখী তুমি কার, এখনই সময়, দুই জীবন, দমকা, জনমদুখী, বিহঙ্গ ইত্যাদি। তাছাড়া ফেরদৌসী মজুমদার: জীবন ও অভিনয় শিরোনামে তিনি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
জীবদ্দশায় তিনি তাঁর নাট্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮২ সালে অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার ও ২০০০ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়া টেলিভিশন নাটক রচনা ও পরিচালনার জন্য প্রথম জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৮) এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দুবার সেরা পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর মৃত্যু ২১ আগস্ট ২০০৮। তিনি গ্রিণ ইউনিভার্সিটির ফিল্ম-টেলিভিশন অ্যাণ্ড ডিজিটাল মিডিয়া বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
লেখক: ডক্টর আফজালে হোসেন খান- বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।
সময় জার্নাল/এমআই