নিজস্ব প্রতিনিধি:
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পরই দৃশ্যপট পাল্টে যায় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের। রাজধানীর গুলিস্তানে অবস্থিত ১০তলা বিশিষ্ট কার্যালয়টিতে বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দেয়, চলে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট। এক সময়ের ব্যস্ত ও দলীয় কর্মসূচিতে মুখরিত এই ভবনটি ক্রমেই পরিণত হয় পরিত্যক্ত ও ভুতুড়ে এক পরিসরে।
কিন্তু সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে ভবনটি। ঝুলছে একটি নতুন ব্যানার—“আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজম ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট”। ব্যানারটির নিচে চলছে জোরেশোরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। ভবনের জানালা-দরজা খুলে ঝাড়ু, পানি দিয়ে ধোয়া, টাইলস তুলতে দেখা গেছে অন্তত ১০-১২ জন শ্রমিককে।
এই ‘গবেষণা ইনস্টিটিউট’ কী, কারা এটি পরিচালনা করছে, সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কেউ এখনো সামনে আসেনি। শ্রমিকদের দেখভাল করছেন একজন সাখাওয়াত হোসেন নামের ব্যক্তি। তিনি জানান, “এটা ফ্যাসিস্ট আমলের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আমরা চাই না এখান থেকে আবার ফ্যাসিজম জন্ম নিক। এজন্য আমরা কার্যক্রম শুরু করব।”
তবে তিনি কোনো দল, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন কিনা—সে বিষয়ে কিছুই বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন বলেন, “আমরা আমাদের দলীয় কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। কারা এই কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে তা আমাদের জানা নেই।”
একই রকম সুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক রিফাত রশিদ বলেন, “আমরাও গণমাধ্যমে বিষয়টি দেখেছি। বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি মো. শাহরিয়ার বলেন, “কার্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ব্যানার লাগানো হয়েছে। সম্প্রতি নতুন ব্যানার টাঙিয়ে কাজ চলছে। তবে আমরা কিছু জানি না। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো নির্দেশনা নেই।”
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, ভবনটি দীর্ঘদিন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। এখানে ছিন্নমূলদের আড্ডা, মাদকসেবন, এমনকি উন্মুক্ত শৌচকর্মও হতো। তারা বলছেন, পরিস্কার করা খারাপ নয়, তবে কারা করছে—সেটা জানা দরকার।
বহুল আলোচিত এই ভবনটির ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৮১ সাল থেকে গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের এই আট কাঠার জমিতে দলীয় কার্যালয় স্থাপন করে আওয়ামী লীগ। সরকারের কাছ থেকে ৯৯ বছরের ইজারায় নেওয়া জমিতে ২০১৬ সালে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় ১০ তলা বিশিষ্ট ভবনটি। এখানেই দল পরিচালনা করত আওয়ামী লীগ।
তবে এর আগে অন্তত আটবার কার্যালয় স্থানান্তর করেছে দলটি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আত্মপ্রকাশের পর দলটি শীর্ষ নেতাদের বাসা থেকেই পরিচালিত হতো। এরপর পর্যায়ক্রমে পুরান ঢাকার কানকুন লেন, সিমসন রোড, নবাবপুর রোড, সদরঘাট, রূপমহল সিনেমা হলের গলি, এবং পুরানা পল্টনের দুটি স্থানে অফিস ছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৮১ সাল থেকে গুলিস্তানের এই ঠিকানায় দলটির কার্যালয় স্থায়ী রূপ পায়।
এর আগেও ভবনটি ঘিরে বিরোধ তৈরি হয়েছিল। “জুলাই যোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয়” নামে একটি ব্যানার টাঙিয়ে ভবন দখলের চেষ্টা হয়। এবার “আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজম ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট” ব্যানারে শুরু হয়েছে সংস্কার।
কেউ কেউ বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া নতুন ছাত্র সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের তত্ত্বাবধানে এ কাজ হচ্ছে। আবার কেউ মনে করছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতারাই গোপনে ভবনটি পুনর্দখলের চেষ্টা করছেন।
একটি ব্যানার দিয়ে ভবন দখলের এই প্রবণতা ভবিষ্যতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
আওয়ামী লীগের পতনের পর গুলিস্তানের এই দলীয় কার্যালয় রূপ নিয়েছে এক রহস্যময় ভবনে। ব্যানারে লেখা প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ও পরিচয় এখনো অজানা। কারা এই কাজের পেছনে রয়েছে, তা স্পষ্ট না হলে ভবনটি ঘিরে সন্দেহ, গুজব এবং অস্থিতিশীলতা বাড়তেই থাকবে।
একে