জাকারিয়া শেখ, কুড়িগ্রাম:
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে তিস্তা নদীর বুকে খুলে গেল উত্তরবঙ্গের মানুষের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের দুয়ার। কুড়িগ্রামের চিলমারী ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর রুটে ১,৪৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের ‘মওলানা ভাসানী সেতু’ বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দুপুর ১টায় ফিতা কেটে সেতুটির উদ্বোধন করেন।
হরিপুর প্রান্তে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হাজারো মানুষ ভিড় জমায়। কেউ মোটরসাইকেল, কেউ গাড়ি, কেউবা বাইসাইকেল ও ইজিবাইকে সেতু পার হয়ে ছুটে আসেন। অনেকেই পায়ে হেঁটে দীর্ঘ সেতুতে দাঁড়িয়ে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করেন। চারদিকে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। তিস্তাপাড়ের মানুষ আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসছিলেন—কারও মুখে হাসি, কারও চোখে স্বপ্ন।
হরিপুরের কলেজ শিক্ষক প্রভাত চন্দ্র পাল বলেন, “তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির নাম ‘মওলানা ভাসানী সেতু’ হওয়ায় আমরা আনন্দিত। মহান নেতার নামে সেতুটি হওয়ায় গর্ববোধ করছি। এটি শুধু যোগাযোগ নয়, তিস্তাপাড়ের মানুষের সংস্কৃতি, শিক্ষা ও অর্থনীতির মেলবন্ধন ঘটাবে।”
একই এলাকার স্কুল শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান, আগে ধারণা ছিল সেতুটির নাম হবে ‘চিলমারী-হরিপুর তিস্তা সেতু’। তবে সর্বশেষ ঘোষণায় এটি ‘মওলানা ভাসানী সেতু’ নাম পেয়ে এলাকাবাসীর আবেগ আরও বেড়েছে।
চিলমারীর প্রবীণ কৃষক আহাদ আলী শেখ (৭৫) বলেন, “আগে নদী পার হতে আমাদের অনেক কষ্ট হতো। শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতি—সব ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে ছিলাম। মরার আগে তিস্তার বুকে এই সেতু দেখতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত।”
চিলমারীর ব্যবসায়ী আশরাফুল হক বলেন, “এই সেতুর ফলে চিলমারী থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার কমে গেছে। এতে সময় ও খরচ বাঁচবে। সোনাহাট স্থলবন্দর ও চিলমারী নদীবন্দরের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হলো।”
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধানে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। অর্থায়ন করে সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এবং ওপিইসি ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি)। নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন।
প্রথমে ২০২৩ সালের জুনে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও বিভিন্ন কারণে পাঁচবার সময় বাড়াতে হয়। অবশেষে ২০ আগস্ট ২০২৫ সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়।
সেতু নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে ২৯০টি পাইল, ৩০টি পিলার, ২৮টি স্প্যান ও ১৫৫টি গার্ডার। পানি নিষ্কাশনের জন্য উভয় প্রান্তে নির্মিত হয়েছে ১২টি ব্রিজ ও ৫৮টি বক্স কালভার্ট। নদীশাসন ও সংযোগ সড়ক মিলিয়ে অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১৩৩ একর জমি এবং নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার সড়ক।
মোট ব্যয়ের মধ্যে সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩৬৭ কোটি টাকা। সংযোগ সড়ক, নদীশাসন, কালভার্ট ও জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে আরও ৩৬৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
তিস্তার ওপর এটি তৃতীয় সড়ক সেতু হলেও দৈর্ঘ্য ও গঠনশৈলীতে সবচেয়ে বড়। এর আগে ২০১২ সালে লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা এলাকায় ৭৫০ মিটার দীর্ঘ প্রথম তিস্তা সেতু নির্মিত হয়—ব্যয় ছিল ৮৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয়টি নির্মিত হয় ২০১৮ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুরে—দৈর্ঘ্য ৮৫০ মিটার, ব্যয় ১৩১ কোটি টাকা।
গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল চৌধুরী বলেন, “স্থানীয়দের দাবির ভিত্তিতে সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে ‘মওলানা ভাসানী সেতু’। এতে একজন মহান নেতার সম্মান রক্ষিত হলো।”
তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সেতুটি চালু হওয়ায় এটি শুধু অবকাঠামো নয়—উত্তরবঙ্গের মানুষের উন্নয়ন, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।”
তিস্তার ওপর জেগে ওঠা এই সেতু শুধু একটি স্থাপনা নয়; এটি উত্তরবঙ্গের লাখো মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান। সংযোগ, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির নবদিগন্ত উন্মোচন করল ‘মওলানা ভাসানী সেতু’।