বুধবার, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সাত সরকারি কলেজেকে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ না করে স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় অধিভুক্ত কলেজ করার দাবিতে ইউজিসিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। এ সময় উচ্চশিক্ষা সংকোচন, নারীশিক্ষার প্রতিবন্ধকতা এবং শতবর্ষী ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য ধ্বংসের হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন তারা।
আজ বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১টায় আগারগাঁওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ভবনের সামনে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ব্যানারে এই মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচিতে এসব কথা বলেন সাত কলেজের শিক্ষকরা।
এ সময় সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যাপক মাহফিল আরা বেগম লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে সাত কলেজকে অব্যাহতি দিয়ে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা চলমান। কিন্তু হঠাৎ করে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামে যে কাঠামো সামনে এসেছে, তা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা সংকোচন, শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৮৭৪ সালে মহসিনিয়া ফান্ডের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত কবি নজরুল সরকারি কলেজ দেশের অন্যতম প্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রায় ২০ হাজার স্নাতক এবং ৩,৫০০ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত এই কলেজ পুরান ঢাকায় শতবর্ষব্যাপী শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। এখানে একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও পরিচালিত হচ্ছে।’
মানববন্ধনে শিক্ষকরা বলেন, জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, গবেষণা শক্তিশালীকরণ এবং ধাপে ধাপে সম্মান কোর্সে রূপান্তরের কথা বলা হলেও প্রস্তাবিত নতুন কাঠামো তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
তাদের ভাষ্য, ‘এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীদের স্বল্প খরচে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হবে। পুরান ঢাকায় উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নির্ভরযোগ্য কবি নজরুল কলেজ রূপান্তরিত হলে দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উত্তর ঢাকায় যেতে হবে, যা শহরের যানজটে নতুন সংকট তৈরি করবে।’
নারীশিক্ষার প্রসঙ্গ তুলে তারা বলেন, ‘ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ দীর্ঘদিন ধরে নারীদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠান সংকুচিত হলে রক্ষণশীল ও পর্দানশীন পরিবারের মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষা বাধাগ্রস্ত হবে, যা সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ, জাতীয় শিক্ষা নীতি এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG ৪.৩ ও ৪.৪)-এর পরিপন্থী।’
তারা আরও বলেন, ‘যদি সকল অংশীজনের মতামত ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত না করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়, তবে ইডেন কলেজের সাম্প্রতিক আন্দোলনের মতো বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে।’
অন্যদিকে, সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার কথা থাকলেও শতবর্ষব্যাপী নারীশিক্ষা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে ইডেন ও বদরুন্নেসার একাডেমিক ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে বলে শিক্ষকদের আশঙ্কা।
তারা বলেন, ‘যদি বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকদের প্রত্যাশা প্রতিফলিত না হয়, তাহলে সেবার মান হ্রাস পাবে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটি বহুমাত্রিক সমস্যার মধ্যে রয়ে গেছে।’
শিক্ষকেরা আরো বলেন, ‘সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থায়ী ক্যাম্পাস ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়াই বছর পার করছে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে।’
শিক্ষকদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, সাত কলেজের বিদ্যমান অবকাঠামো ও মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে কলেজিয়েট বা অধিভুক্ত কাঠামোর আওতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করা হোক। পাঠদান ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকুক বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার।
এছাড়া, প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণা বাজেট বরাদ্দ, আধুনিক ল্যাব ও গ্রন্থাগার সুবিধা, আবাসন সংকট নিরসন এবং বৃত্তি বাড়ানোর মাধ্যমে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা।
এমআই