সুমন আকন:
আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস (World Teachers' Day)। আমাদের মতো প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য দিনটি কেবল আনুষ্ঠানিক সম্মাননার নয়, বরং জাতির শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের মৌলিক ভূমিকাটি পুনর্বিবেচনা করার দিন।
শুরুতেই বলি, শিক্ষক কে?
শিক্ষক তিনি শুধু তথ্য প্রদানকারী নন; তিনি হলেন পথপ্রদর্শক, অনুপ্রেরণাদাতা ও শিশুর সুপ্ত সম্ভাবনা বিকাশের প্রধান সহায়ক। আর *প্রাথমিক শিক্ষা* হলো সেই ভিত্তি, যেখানে একটি শিশুর জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়ী কাঠামো তৈরি হয়। আমরাই শিশুদের জীবনের প্রথম আলোর দিশারী।
শিক্ষকের ভূমিকা: একটি পবিত্র ব্রত ও জীবনের ভিত্তি স্থাপন
শিক্ষকতা পেশা আমাদের কাছে কেবল একটি চাকরি নয়, এটি একটি পবিত্র ব্রত। আমি আমার চাকরি জীবনের শুরুটা করি ১৯০নং পশ্চিম তেলিগাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।সদ্য আমি ২০৭নং গাবগাছিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসি। দুটি বিদ্যালয়ে কর্মরত থেকে আমি দেখেছি, আমাদের কাজ হলো প্রতিটি শিক্ষার্থীকে—বিশেষ করে যারা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী—তাদের কাছে শিক্ষাকে আনন্দময় ও আকর্ষণীয় করে তোলা।
আমরা শ্রেণিকক্ষে শুধু বর্ণ পরিচয় করাই না, আমরা তাদের শেখাই প্রশ্ন করতে, স্বপ্ন দেখতে এবং নির্ভয়ে নিজেদের প্রকাশ করতে। প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে আমরা প্রতিটি শিশুর মধ্যে অনুসন্ধিৎসু মন, মানবিক মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমের বীজ বপন করি। এই স্তরেই তারা শৃঙ্খলা, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মতো সামাজিক দক্ষতা অর্জন করে। একটি শিশুর ভবিষ্যৎ পথ মসৃণ করার এই কাজটিই প্রাথমিক শিক্ষককে এক অনন্য মর্যাদার আসনে বসায়।
নতুন শিক্ষাক্রম:সম্ভাবনা ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ
সরকার কর্তৃক প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রম নিঃসন্দেহে একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ। এটি মুখস্থ বিদ্যাকে বিদায় জানিয়ে, শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখা ও অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক শিক্ষার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন শ্রেণিকক্ষে একজন সহায়ক (Facilitator) হিসেবে কাজ করি।
তবে এই যুগান্তকারী পরিবর্তন সফল করতে কিছু কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ জরুরি ভিত্তিতে মোকাবিলা করতে হবে:
প্রযুক্তি ও উপকরণের অভাব: নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ক্লাসরুম, মাল্টিমিডিয়া সুবিধা ও আধুনিক শিক্ষা উপকরণের অভাব অনেক গ্রামীণ বিদ্যালয়ে প্রকট।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত: অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম। এতে নতুন শিক্ষাক্রমের প্রাণ, অর্থাৎ দলগত কাজ ও ব্যক্তিগত মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রশিক্ষণের ধারাবাহিকতা: শিক্ষকদের শুধু একবার প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না, বরং নিয়মিত ও মানসম্পন্ন ফলো-আপ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
শিক্ষকদের স্বল্প বেতন ও কঠিন জীবনযাত্রা: নীরব কান্না
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি, এই পেশার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি নিয়ে আলোচনা করা অপরিহার্য—তা হলো প্রাথমিক শিক্ষকদের স্বল্প বেতন এবং কঠিন জীবনযাত্রা।
আজকের এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে, একজন প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন প্রায়শই পরিবার নিয়ে সম্মানজনক জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে যথেষ্ট হয় না। জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদা মেটানোর পর, সন্তানের ভালো শিক্ষা নিশ্চিত করা বা নিজের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। এই আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে অনেক শিক্ষককে বাধ্য হয়ে বাড়তি কাজের সন্ধান করতে হয়, যা তার শ্রেণিকক্ষের মনোযোগকে ব্যাহত করে।
এই বেতন স্বল্পতা শুধু শিক্ষকের ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি শিক্ষার গুণগত মানকেও সরাসরি প্রভাবিত করে। যখন মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণরা দেখেন যে এই গুরুত্বপূর্ণ পেশায় আর্থিক নিরাপত্তা নেই, তখন তারা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহ হারান। ফলস্বরূপ, শিক্ষার মূল ভিত্তি অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরে মেধাবী শিক্ষকের অভাবের মতো গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়।
আমরা সরকারকে অনুরোধ জানাই, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করা হোক, যা তাদের যোগ্যতা ও জাতির প্রতি তাদের অপরিহার্য ভূমিকার প্রতি সুবিচার করে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে শিক্ষকরা দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে শ্রেণিকক্ষে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারবেন।
আমাদের অঙ্গীকার ও চূড়ান্ত আহ্বান
আমরা, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা, আমাদের কাজের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠাই এই পেশার সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা চাই, আমাদের যোগ্যতা ও ভূমিকার প্রতি ন্যায়বিচার করা হোক।
আসুন, বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এই আলোচনা কেবল এক দিনের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে, শিক্ষকদের সম্মান, নিরাপত্তা ও সক্ষমতাকে একটি জাতীয় অগ্রাধিকারের বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি। সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই আমরা ২০৭নং গাবগাছিয়া স. প্রা. বিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে জ্ঞান ও আলোর কেন্দ্রে পরিণত করতে পারব। শুভ কামনা সকল শিক্ষককে।
আজকের এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমার সকল শিক্ষাগুরু শিক্ষকদের। লেখক:--সুমন আকন-সহকারী শিক্ষক, ২০৭নং গাবগাছিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট।
লেখক: সুমন আকন-সহকারী শিক্ষক।