ইবতেশাম রহমান সায়নাভ:
দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা যখন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো—বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা—আরও বেশি নজরদারি দাবি করে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) সেই দিক থেকে সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে যা নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র ও দুর্বলতাকে স্পষ্টভাবে সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন উঠেছে—বেরোবি ক্যাম্পাস কতটা নিরাপদ? আর এই নিরাপত্তাহীনতার মূল কারণটাই বা কোথায়?
নিরাপত্তা চাদরের ভেতরেও শঙ্কা
গত ১৬ জুলাই, ‘জুলাই শহীদ দিবস’-২০২৫ পালন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে কঠোর নিরাপত্তা ছিল। দুজন উপদেষ্টার উপস্থিতি থাকায় প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্কতায় ছিল। কিন্তু এত নিরাপত্তার মাঝেই দেয়ালে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ হাসিনা ফিরবে’ ধরনের রাজনৈতিক লেখনী ওঠে। প্রশ্ন—এমন নজরদারির মধ্যেও কারা এ কাজটি করল? এবং কেন প্রশাসন এখনও তা শনাক্ত করতে ব্যর্থ?
হলে বহিরাগত—ক্যাম্পাসে অগোচর প্রবেশ
১২ নভেম্বর ছাদে লোহা সংগ্রহ করতে আসা দুই বহিরাগতকে চোর সন্দেহে আটক করা হয়। তার পরদিন গোপন ক্যামেরাসহ আরেকজন ধরা পড়েন—চশমার ভেতরে লুকানো ক্যামেরায় শিক্ষার্থীদের ছবি ধারণ করছিলেন তিনি। সপ্তাহের ছুটির দিনে ২–৩ হাজার বহিরাগত মানুষের অবাধ বিচরণ এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। ছোট ক্যাম্পাসে এ ধরনের ভিড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ঝুঁকি যে বাড়ে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শিক্ষকদের মধ্যেই সংঘর্ষ—নিরাপত্তাহীনতার নতুন মাত্রা
একজন সহকারী প্রক্টর দায়িত্ব পালনকালে অন্য শিক্ষকের দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা শুধু দুঃখজনকই নয়—এটি পুরো ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থার ভঙ্গুরতাকে তুলে ধরে। যারা নিরাপত্তা রক্ষায় ভূমিকা রাখবেন, তারাই যখন সংঘর্ষে জড়ান, তখন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায় দাঁড়ায়?
প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা, পুলিশের হাত বাঁধা
বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ স্বীকার করেছেন—তাদের নিজের থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্দেশনা না দিলে তারা নড়তেও পারে না। বহিরাগত প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, অন্ধকার জায়গায় আলো বসানো, টহল বৃদ্ধির মতো সাধারণ কাজেও প্রশাসনের ধীরগতি নিরাপত্তাহীনতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ—প্রশাসনের উদাসীনতা
মার্কেটিং, পদার্থবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান বিভাগের সংঘর্ষে একজন শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। কিন্তু প্রশাসন আহত শিক্ষার্থীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বদলে মিটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আহত শিক্ষার্থী ৩–৪ ঘণ্টা রক্তাক্ত অবস্থায় ক্লাসরুমে পড়ে ছিল—এ এক নির্মম উদাসীনতা।
প্রক্টর ও উপাচার্যের বক্তব্য—আশ্বাস, নাকি দায়িত্ব এড়ানো?
প্রক্টর দাবি করেছেন—টহল বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। উপাচার্যও বলেছেন—প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, সমস্যার মূল জায়গাগুলোতে এখনো টেকসই পদক্ষেপ নেই।
প্রশাসনের বিবৃতির সঙ্গে বাস্তবতার দূরত্ব যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ নিরাপত্তাহীনতা থেকেই যাবে।
তাহলে প্রশ্ন একটাই—বেরোবি কতটা নিরাপদ?
বেরোবি বর্তমানে একটি “ওপেন ক্যাম্পাস”—যেখানে যে কেউ প্রবেশ করতে পারেন। রাজনৈতিক উত্তাপ, বহিরাগত ভিড়, প্রশাসনিক বিভ্রাট এবং শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করেছে।
স্বাধীনচেতা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের মূল সৌন্দর্য নিরাপদ পরিবেশে বিকাশের মধ্যে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ই নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে শিক্ষার্থীরা কোথায় নিরাপত্তা খুঁজবে?
অবিলম্বে যা করা জরুরি
সম্পূর্ণ বহিরাগত প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ
ক্যাম্পাসজুড়ে সিসিটিভি কাভারেজ বৃদ্ধি
অন্ধকার জায়গায় আলো
পুলিশের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ
প্রক্টরিয়াল বডির কার্যকারিতা বাড়ানো
শিক্ষকদের শৃঙ্খলা ও আচরণে কঠোরতা
সংঘর্ষে দ্রুত উদ্ধার ও চিকিৎসা ব্যবস্থা
শেষ কথা বেরোবি শুধুই একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়—এটি জুলাই অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। তাই এই ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু প্রশাসনের কর্তব্য নয়—একটি জাতীয় দায়িত্বও বটে।
যে ক্যাম্পাসে আমরা পড়ি, স্বপ্ন দেখি, বেড়ে উঠি—সেই ক্যাম্পাসকেই আগে নিরাপদ হতে হবে।
লেখক: ইবতেশাম রহমান সায়নাভ
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।