মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

আধিপত্যবাদ বিরোধী শেষ স্তম্ভ খালেদা জিয়ার বিদায়: ইতিহাস, সংগ্রাম ও এক মজলুম নেত্রীর উত্তরাধিকার

মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৫
আধিপত্যবাদ বিরোধী শেষ স্তম্ভ খালেদা জিয়ার বিদায়: ইতিহাস, সংগ্রাম ও এক মজলুম নেত্রীর উত্তরাধিকার

 ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম

বাংলাদেশ আজ এক গভীর শোকের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থানের প্রতীক, আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের শেষ দৃঢ় স্তম্ভ—দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর মজলুমা বান্দীকে নিজের জিম্মায় নিয়ে গেছেন।ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপার্সন এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমকালীন ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী মুসলিম নেত্রী। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত বাংলার জলপাইগুড়িতে তাঁর জন্ম। বাবা ইস্কান্দর মজুমদার ও মা বেগম তৈয়বা মজুমদারের আদর্শ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে গড়ে ওঠা এই নারী একসময় পরিণত হন জাতির অভিভাবকে।

গৃহিণী থেকে রাষ্ট্রনায়ক

খালেদা জিয়ার জীবন কোনো প্রস্তুত রাজনীতিবিদের জীবন ছিল না। একজন সাধারণ মুসলিম গৃহিণী হিসেবেই তাঁর জীবনযাত্রা শুরু। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে নিয়ে যায় ভিন্ন এক গন্তব্যে। অকুতোভয় সেনানী, ১৯৬৫ সালে ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিরোধে বীরত্ব প্রদর্শনকারী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করেন রাষ্ট্র, রাজনীতি ও জাতির ভাগ্য নির্ধারণের কঠিন বাস্তবতা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ঘোষণা, স্বাধীন রাষ্ট্রের সেনাপ্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা, পরবর্তী সময়ে সাতই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব—এই সব ঘটনাপ্রবাহের নীরব সাক্ষী ছিলেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালের ৩০ মে শহীদ জিয়ার শাহাদাতের পর ইতিহাস তাঁকে সামনে ঠেলে দেয়। তিনি রাজনীতির হাল ধরেন, কেবল উত্তরাধিকার হিসেবে নয়—নিজ যোগ্যতায়।

স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম

স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মোড় নিয়ে আসে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৯১ সালের নির্বাচন এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন—সবখানেই তাঁর দৃঢ় নেতৃত্ব স্পষ্ট। তিনি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং নারী শিক্ষার প্রসারসহ সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল—ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও দেশীয় দালাল শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান। এই অবস্থানই তাঁকে বারবার ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও প্রতিহিংসার মুখে ফেলেছে।

বিচার নয়, প্রতিহিংসার রাজনীতি

১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের ভূমিধস বিজয় এবং পরবর্তী আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ষড়যন্ত্র—সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার শাসনামল ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। ‘ওয়ার অন টেরর’-এর নামে সরকারকে টার্গেট করা, জঙ্গিবাদের অপবাদ আরোপ এবং অবশেষে ২০০৭ সালের ১/১১—এসব ছিল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।

২০০৮ সালের পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার পর শুরু হয় খালেদা জিয়াকে ধ্বংস করার নির্মম অধ্যায়। মিথ্যা মামলা, বারবার আদালতে হাজিরা, কারাবরণ—সব মিলিয়ে নয় বছরের বেশি সময় তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়। কারাগারে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না দিয়ে ধীরে ধীরে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এটি কোনো বিচারের প্রক্রিয়া ছিল না; ছিল পরিকল্পিত রাজনৈতিক নিপীড়ন।

শেষ পর্যন্তও আপসহীন

দুঃখজনক সত্য হলো—গত পনেরোটি বছর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তাঁকে অসীম কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। স্বামীর স্মৃতি জড়ানো ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ ছিল নিছক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি ছিল রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার গভীর সংকটের বহিঃপ্রকাশ।

তবুও তিনি ভাঙেননি। বন্দিদশায়, অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি আপসহীন ছিলেন। আল্লাহর রহমতে মুক্তি পেয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে যখন তিনি ধীরে ধীরে সুস্থতার পথে, তখন জাতি আবারও আশাবাদী হয়েছিল—তিনি হয়তো ফ্যাসিবাদ-উত্তর বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যের নেতৃত্ব দেবেন।
কিন্তু মহান আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দীকে দুনিয়ার জুলুম থেকে মুক্ত করে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে নিয়েছেন।

একটি উত্তরাধিকার, একটি দায়িত্ব

খালেদা জিয়া ছিলেন জাতির অভিভাবক, ঐক্যের প্রতীক এবং আধিপত্যবাদ বিরোধী রাজনীতির শেষ দৃঢ় স্তম্ভ। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সংগ্রাম, আদর্শ ও ত্যাগ আমাদের জন্য দায়িত্ব হয়ে রইল।

আজ আমরা শুধু দোয়ায় থেমে থাকতে চাই না। আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে ফরিয়াদ করি—যাঁরা তাঁর ওপর অন্যায় ও অবিচার করেছে, আল্লাহ যেন তাদের কৃতকর্মের বিচার এই দুনিয়াতেই দৃশ্যমান করেন। যেন জালিমদের জন্য এটি হয় সতর্কবার্তা, আর মজলুমদের জন্য ন্যায়বিচারের আশা।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সবর দান করুন, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকার তাওফিক দিন। (আমিন)

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
কলামিস্ট, সমাজসেবক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী ও রাজনীতিবিদ
চেয়ারম্যান — বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র
চেয়ারম্যান — সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট
চেয়ারম্যান — ডেমোক্রেসি রিসার্চ সেন্টার (ডিআরসি)


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল