মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫

৪০ বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ খরায় যে দেশ; কলের পানিও শুকানোর পথে, দেখা যাচ্ছে মহাকাশ থেকেও

মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ২, ২০২৫
৪০ বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ খরায় যে দেশ; কলের পানিও শুকানোর পথে, দেখা যাচ্ছে মহাকাশ থেকেও

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে, কেউবা মাথা নুইয়ে প্রার্থনা করছেন। সবার একটাই চাওয়া—একটু বৃষ্টি। ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি মসজিদের দৃশ্য এটি। সপ্তাহ গড়িয়ে মাস যাচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। উল্টো তীব্র পানি সংকটে ধুঁকছে প্রায় দেড় কোটি মানুষের এই বিশাল শহর।

পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে খোদ ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান শহর খালি করে ফেলার ইঙ্গিত দিয়ে সতর্ক করেন, ডিসেম্বরের মধ্যে বৃষ্টি না হলে পানিতে রেশনিং করতে হবে। আর খরা এভাবে চলতে থাকলে বাসিন্দাদের হয়তো শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।

অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এত বড় শহর খালি করা বাস্তবে অসম্ভব। তবে প্রেসিডেন্টের এমন কথায় পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করা যাচ্ছে।

শুধু তেহরান নয়, পুরো ইরানই এখন খরার কবলে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক মহসেন বি মেসগারান জানান, গত সেপ্টেম্বরে বর্ষা মৌসুম শুরুর পর থেকে দেশটির প্রায় ২০টি প্রদেশে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ইরানের প্রায় ১০ শতাংশ বাঁধ বা জলাধার কার্যত শুকিয়ে গেছে। 

ইরান মূলত অর্ধ-শুষ্ক একটি দেশ। পানির সংকট সেখানে নতুন কিছু নয়। তবে রাজধানী তেহরান সচরাচর এমন বিপদে পড়ে না। দেশের বিত্তশালী ও ক্ষমতাধরদের বাস যে শহরে, সেই তেহরানও এবার রেহাই পাচ্ছে না।

ইরানের এই পানি সংকটের মূল কারণগুলো বিশ্বের অন্যান্য অংশের মতোই। দশকের পর দশক ধরে ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত তুলে নেওয়া, পুরোনো ও লিক হওয়া পাইপলাইন, নদীর ওপর অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির অভিযোগ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। 

এর সঙ্গে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। আবহাওয়া দিন দিন উষ্ণ ও শুষ্ক হয়ে ওঠায় বছরের পর বছর ধরে জলাধারগুলো খালিই থাকছে, ভরছে না।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিারিংয়ের অধ্যাপক আমির আগাকুচক বলেন, গত ৪০ বছরের মধ্যে এটিই ইরানের সবচেয়ে ভয়াবহ খরা। বছরের এই সময়ে সাধারণত জলাধারে পানি জমতে শুরু করে, অথচ এখন উল্টো পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাচ্ছে।

ইরানের আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা মেহর নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেহরানের পানি ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক মহসেন আরদাকানি জানিয়েছেন, শহরের প্রধান জলাধারগুলোতে এখন মাত্র ১১ শতাংশ পানি অবশিষ্ট আছে।

তেহরান শহর থেকে প্রায় ১৫ মাইল দূরের লাতিয়ান বাঁধ। আলবোর্জ পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত এই জলাধারে পানি অবশিষ্ট আছে মাত্র ৯ শতাংশ। গত মে মাস থেকে পানি কমতে কমতে এটি এখন প্রায় ধু–ধু প্রান্তরে পরিণত হয়েছে। একসময়ের প্রমত্তা নদীর বুকে এখন শুধু সরু ধারায় পানি বইছে।

তেহরানের ৪০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আমির কবির বাঁধের অবস্থাও করুণ। রয়টার্সের তথ্যমতে, এই বাঁধের ধারণক্ষমতার মাত্র ৮ শতাংশ পানি এখন অবশিষ্ট আছে।

কেবল রাজধানীতেই নয়, ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদেও একই হাহাকার। প্রায় ৩০ লাখ মানুষের এই শহরে পানি সরবরাহকারী জলাধারগুলোতে মাত্র ৩ শতাংশ পানি রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এক কর্মকর্তা।

জাতিসংঘের পানি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক ইনস্টিটিউটের পরিচালক কাভেহ মাদানি বলেন, এটি কোনো সাময়িক বিপর্যয় নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি এক মহাবিপর্যয়, যা অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনছে। ইরানের পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক এই উপপ্রধান দেশটিকে 'পানি দেউলিয়া' হিসেবে অভিহিত করে বলেন, নদী বা হ্রদ এবং ভূগর্ভস্থ পানির মজুত—উভয় উৎস থেকেই অনেক দ্রুতগতিতে পানি খরচ করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জবাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সরকারি নীতিই এই পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী। অধ্যাপক আমির আগাকুচক বলেন, 'দশক ধরে শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে সেচভিত্তিক কৃষি সম্প্রসারণের নীতি উৎসাহিত করা হয়েছে।'

১৯৭৯ সালের পর থেকে দেশটিতে সেচনির্ভর কৃষিজমি দ্বিগুণ হয়েছে। বিশেষ করে ইরানিদের প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। ইরানের মোট পানির প্রায় ৯০ শতাংশই এখন কৃষিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অব্যবস্থাপনার নির্মম শিকার উত্তর-পশ্চিম ইরানের উরমিয়া হ্রদ। একসময়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম নোনা পানির এই হ্রদটি গত কয়েক দশকে শুকিয়ে জৌলুশ হারিয়েছে। খরার পাশাপাশি কৃষি জমিতে পানি দিতে হ্রদের আশপাশে বাঁধ ও গভীর নলকূপ বসানোই এর প্রধান কারণ। অধ্যাপক মেসগারানের মতে, এসব কর্মকাণ্ড হ্রদটির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।

ইরানের শুষ্ক ও অর্ধ-শুষ্ক এলাকাগুলোতে তেল-গ্যাসের মতো প্রচুর পানি ব্যবহারকারী শিল্পকারখানা গড়ে তোলায় পানির সংকট আরও তীব্র হয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহরে বাড়ছে মানুষের চাপ। পুরোনো ও জরাজীর্ণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও এ সংকটের অন্যতম কারণ।

অধ্যাপক মেসগারান বলেন, 'পরিশোধন করা সুপেয় পানির প্রায় ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায় পুরোনো ও লিক হওয়া পাইপলাইনের কারণে। এ ছাড়া পানি পুনর্ব্যবহার বা রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থাও নেই বললেই চলে।' পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে কাভেহ মাদানি বলেন, 'অব্যবস্থাপনার কারণে ঘরে আগে থেকেই আগুন লেগেছিল, এখন জলবায়ু পরিবর্তন তাতে ঘি ঢালছে।' 

ইরানে টানা ষষ্ঠ বছরের মতো খরা চলছে। মাদানির মতে, আধুনিক সময়ে এমন দীর্ঘমেয়াদি ও তীব্র খরা নজিরবিহীন। ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মানুষের কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন না থাকলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিহীনতার এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

এদিকে, তেহরানবাসীর দিন কাটছে গভীর উদ্বেগে। শরতে বৃষ্টির আশা থাকলেও ছিটেফোঁটা ছাড়া কিছুই মেলেনি। কর্তৃপক্ষ বলছে, আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো রেশনিং শুরু হয়নি। তবে বাসিন্দাদের অভিযোগ, কলে পানির চাপ খুবই কম। মাঝেমধ্যে তো পানিই থাকছে না।

সরকারের অসংলগ্ন কথাবার্তায় সাধারণ মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। মাদানি জানান, হতাশা থেকে নানা 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' ডালপালা মেলছে। অনেকেই মনে করছেন, বিদেশি শক্তি হয়তো ইরানের আবহাওয়া পরিবর্তন করে দিচ্ছে বা 'মেঘ চুরি' করছে।

প্রেসিডেন্ট শহর ছাড়ার ইঙ্গিত দিলেও বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব। 'মানুষ যাবে কোথায়? দেশ এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ পরিবারের পক্ষেই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসবাস করার সামর্থ্য নেই,' বলেন অধ্যাপক মেসগারান। 

তবে পানি বাঁচাতে সাময়িকভাবে শহর ছাড়ার মতো পদক্ষেপ দেখা যেতে পারে। গত গ্রীষ্মে মানুষকে শহর ছাড়তে উৎসাহিত করতে জরুরি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল কর্তৃপক্ষ। 'যখন হাতে মাত্র কয়েক দিন বা সপ্তাহের পানি জমা থাকে, তখন কয়েক ঘণ্টার জন্য পানি সাশ্রয় করাটাও অনেক বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে,' বলেন কাভেহ মাদানি। 

সরকার অবশ্য কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি (ক্লাউড সিডিং) নামানোরও চেষ্টা করেছে। এই পদ্ধতিতে মেঘের মধ্যে বিশেষ কণা ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে বৃষ্টি বা তুষারপাত হয়। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। মাদানির মতে, 'সরকারগুলো যে হাত গুটিয়ে বসে নেই, বরং কিছু একটা করছে—তা দেখানোর জন্য এটি একটি ভালো কৌশল।'

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি সংকট মোকাবিলায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষ করে কৃষির মতো যেসব খাতে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়, অর্থনীতিকে সেখান থেকে সরিয়ে আনতে হবে। তবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সরকারের জন্য বেশ কঠিন। কারণ, এতে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে এবং বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আপাতত বৃষ্টির জন্য প্রার্থনাই কর্মকর্তাদের একমাত্র ভরসা। তেহরান সিটি কাউন্সিলের প্রধান মেহেদি চামরান বলেন, 'আগে মানুষ মরুভূমিতে গিয়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করত। আমাদের সেই ঐতিহ্য ভুলে যাওয়া উচিত নয়।'

তবে পরিস্থিতি এখন এতটাই জটিল যে বৃষ্টি এলেও সংকট পুরোপুরি কাটবে না। অধ্যাপক আমির আগাকুচক বলেন, 'প্রকৃতি এখন কঠোর সীমা টেনে দিচ্ছে।' তার মতে, ভূগর্ভস্থ যে আধারগুলো একবার খালি হয়ে গেছে, তা আর পূরণ হবে না। ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্র চটজলদি পুনরুদ্ধার করাও সম্ভব নয়।

আগাকুচক সতর্ক করে বলেন, সরকার অর্থবহ সংস্কারে যত দেরি করবে, সমাধানের পথ ততই সংকুচিত হয়ে আসবে। পানি সংকট এখন আর কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়; এটি ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।

এমআই 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল