ফিচার ডেস্ক:
আমাদের পাসপোর্টের ছবি সাধারণত আমাদের জীবনের সবচেয়ে কম সুন্দর ছবিগুলোর একটি। ছবি তোলার সময় কড়া নির্দেশ থাকে—হাসা যাবে না, মুখ গম্ভীর রাখতে হবে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, অন্য সব ছবিতে আমরা হাসিখুশি থাকলেও পাসপোর্টের ছবিতে কেন হাসা নিষেধ? এর পেছনে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
যুক্তরাষ্ট্র আসলে সরাসরি হাসি নিষিদ্ধ করেনি। স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়ম অনুযায়ী, পাসপোর্ট ছবিতে থাকতে হবে 'নিরপেক্ষ মুখভঙ্গি, চোখ দুটো খোলা এবং মুখ বন্ধ'। ক্যামেরার দিকে সোজা তাকিয়ে থাকতে হবে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র হাফিংটন পোস্টকে বলেন, 'আবেদনকারী চাইলে সামান্য হাসতে পারেন। শুধু শর্ত হলো—চোখ দুটো খোলা থাকতে হবে এবং মুখ বন্ধ থাকতে হবে।'
অর্থাৎ, দাঁত বের করা যাবে না। আর এটি মূলত সীমান্ত নিরাপত্তার স্বার্থেই করা হয়।
পাসপোর্ট-ফটো ডট অনলাইনের বায়োমেট্রিক ফটোগ্রাফি বিশেষজ্ঞ কারোলিনা তুরোভস্কা বলেন, 'হাসি না দেওয়ার প্রধান কারণ হলো বিমানবন্দর ও সীমান্তে ব্যবহৃত ফেসিয়াল রিকগনিশন বা চেহারা শনাক্তকরণ সফটওয়্যারের ব্যবহার।'
বর্তমানে অনেক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসারের বদলে কম্পিউটার বা মেশিন যাত্রীদের পাসপোর্ট স্ক্যান ও ছবি তোলে। মানুষ সহজেই একে অপরের মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে পারে, কিন্তু মেশিনের জন্য তা কঠিন।
কারোলিনা ব্যাখ্যা করেন, 'অ্যালগরিদম মানুষের মতো কাজ করে না। মেশিন থ্রি-ডি মুখকে টু-ডি ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। এজন্য চোখের দূরত্ব, কানের অবস্থান, নাক-মুখের মাপ—এসব খুব নিখুঁতভাবে পরিমাপ করতে হয়। হাসলে মুখের অনুপাত বদলে যায়, ফলে মেশিন বিভ্রান্ত হতে পারে।'
ফ্লাইট এলার্ট সার্ভিস গোয়িং-এর মুখপাত্র কেটি ন্যাস্ট্রোও বলেন, 'নিয়মটা আসলে পুরো হাসি নিষিদ্ধ করা নয়—মানে দাঁত বের করে স্কুলের প্রথম দিনের মতো হাসি দেওয়া যাবে না। দাঁত দেখা গেলে চোখের রঙ, মুখের আকৃতি—এসব যাচাই করা কঠিন হয়ে যায়।'
'বর্তমানে বেশিরভাগ সীমান্তে ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাই মুখের নির্দিষ্ট বিন্দুর অবস্থান সরে গেলে যন্ত্রের পক্ষে বায়োমেট্রিক তথ্য যাচাই করা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়', যোগ করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক নিয়ম
পাসপোর্টের ছবিতে না হাসার নিয়মটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, বরং বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জন্যই প্রযোজ্য। কারোলিনা তুরোস্কা জানান, দেশভেদে 'নিরপেক্ষ অভিব্যক্তি'র সংজ্ঞা ভিন্ন হতে পারে। যেমন, ফরাসি নিয়মে ঠোঁটের কোণ সামান্য ওপরে ওঠানোও নিষিদ্ধ।
ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও) ভ্রমণ নথির জন্য বৈশ্বিক মান নির্ধারণ করে। তাদের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, অতিরঞ্জিত অভিব্যক্তি পাসপোর্টধারীকে শনাক্ত করা কঠিন করে তোলে। ২০০৪ সালে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ এই নিয়মগুলো হালনাগাদ করে।
তবে পাসপোর্টের নিয়ম সবসময় এতটা কড়া ছিল না। ১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালু হয়। দ্য পয়েন্টস গাই-এর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ম্যাডিসন ব্লাঙ্কাফ্লোর বলেন, 'শুরুর দিকে পাসপোর্টের ছবিতে বাদ্যযন্ত্র বাজানো বা টুপি পরা অবস্থায়ও মানুষের ছবি দেখা যেত। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে গত কয়েক বছরে নিয়ম অনেক কঠোর হয়েছে।'
হাসলে কী সমস্যা হতে পারে?
কেটি নাস্ট্রো জানান, পাসপোর্ট প্রক্রিয়াকরণে বিলম্বের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো অনুপযুক্ত ছবি। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, নির্দেশনা না মানলে সুন্দর হাসির ছবিও বাতিল হতে পারে। তাই ঝুঁকি না নিয়ে স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে ছবি তোলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
নিয়ম অমান্য করে হাসলে বা দাঁত বের করলে আবেদন আটকে যেতে পারে এবং নতুন ছবি জমা দেওয়ার নোটিশ আসতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সঠিক ছবি দিতে না পারলে আবেদনটি বাতিল হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
এছাড়া, চিকিৎসা কারণ ছাড়া চশমা পরা এবং ধর্মীয় কারণ ছাড়া টুপি বা মাথা ঢাকাও পাসপোর্টের ছবিতে নিষিদ্ধ। মুখ বাঁকানো বা কপাল কুঁচকানোও যাবে না।
তবে শিশুদের ক্ষেত্রে নিয়ম কিছুটা শিথিল। কারোলিনা তুরোস্কা বলেন, 'শিশুদের দীর্ঘক্ষণ স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ধরে রাখা কঠিন। তাই তাদের হাসিতে যদি মুখের বৈশিষ্ট্য চিনতে সমস্যা না হয় এবং চোখ খোলা ও ক্যামেরা বরাবর তাকানো থাকে, তবে কর্তৃপক্ষ সাধারণত তা গ্রহণ করে।'
এমআই