ডা. কামরুল হাসান সোহেল :
স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হলে তা শুরু করতে হবে তৃণমূল থেকেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। গ্রামের মানুষগুলো যেন মোটামুটি ভাল মানের চিকিৎসা সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভাল সেবা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে হবে। চিকিৎসা সেবা একটি টিম ওয়ার্ক। শুধু চিকিৎসক নিয়োগ দিলেই চিকিৎসা পাওয়া নিশ্চিত হয় না,শুধু নার্স নিয়োগ দিলেই চিকিৎসা সেবা পাওয়া নিশ্চিত হয় না।অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীও আবশ্যক ভাল মানের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হলে। বাংলাদেশের অধিকাংশ হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবলের তীব্র সংকট। হাসপাতাল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা কঠিন হয়ে গেছে, রোগীদের চিকিৎসা ছাড়া অন্যান্য সেবা দেয়া কঠিন হয়ে পরেছে। জরুরি ভিত্তিতে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়োগ দেয়া জরুরি।
অনেক উপজেলায় ৫০ শয্যার অবকাঠামো আছে কিন্তু ৩১ শয্যা চালাতে যত জনবল প্রয়োজন তা ও নেই। ৩১ শয্যার হাসপাতালগুলোতেও জনবলের সংকট। বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যথেষ্ট পরিমাণে চিকিৎসক ও নার্স কর্মরত রয়েছেন কিন্তু সাপোর্টিং স্টাফের ঘাটতির জন্য উপজেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা।
অধিকাংশ উপজেলায় মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নেই, তাই রোগ নির্ণয়ের জন্য সাধারণ প্যাথলজিক্যাল টেস্টগুলো ও করানো সম্ভব হয় না। তাই রোগীদের ছুটতে প্রাইভেট ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে।আর অসৎ, মুনাফালোভীরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনুমোদন নিয়ে বা না নিয়েই নিম্নমানের ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসে রোগীদের সাথে প্রতারণা করছে।
কোথাও কোথাও মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট আছে, প্যাথলজি ল্যাব আছে কিন্তু এখনো কলোরিমিটার ছাড়া তেমন কোন যন্ত্রপাতি নেই তাই হিমোগ্লোবিন, ই এস আর, ইউরিন আর/এম/ই ছাড়া তেমন কোন টেস্ট করা যায় না।একটা এনালাইজার মেশিন দিলে অনেকগুলো টেস্ট করা যেত।
অনেক উপজেলায় এক্সরে মেশিন আছে কিন্তু এক্সরে টেকনিশিয়ান নেই তাই অকেজো পরে আছে এক্সরে মেশিনটি। কোথাও কোথাও ১৫ বছর ধরে এখনো বাক্সবন্দি হয়ে পরে আছে এক্সরে মেশিন কেননা এক্সরে মেশিন চালানোর মত প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সাপ্লাই নেই, অবকাঠামো নেই, এক্সরে টেকনিশিয়ান নেই।এইসব নেই জেনেও ১৫ বছর আগেই এক্সরে মেশিন পাঠিয়ে দিয়েছে উপজেলায় এবং তা বাক্সবন্দি অবস্থায় পরে থেকেই নষ্ট হয়েছে।এক্সরে মেশিন দিয়েছে কিন্তু একটা ইসিজি মেশিন দেয় নাই।
ফার্মাসিস্ট নেই,ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট নেই, ডেন্টাল মিনি ওটি নেই, যন্ত্রপাতি নেই, কি কি নেই তার তালিকা করতে বসলে দিন শেষ হয়ে যাবে কিন্তু তালিকা শেষ হবে না।
মাঠ পর্যায়ে ও রয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীর তীব্র সংকট, স্বাস্থ্য সহকারীর সংকট প্রায় সব উপজেলায় তাই নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকেও রয়েছে অনেক সমস্যা।অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিক করা হয়েছে যেখানে ভাল রাস্তা নেই, বর্ষায় পানি উঠে, সীমানা প্রাচীর নেই আরো অনেক সমস্যা আছে।
উপজেলায় অফিস স্টাফের ও রয়েছে তীব্র সংকট। পরিসংখ্যানবিদ নাই, ক্যশিয়ার নাই, অফিস সহায়ক নাই। প্রয়োজনীয় জনবলের অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ জনবল দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো।
অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসন সংকট চরম। চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের থাকার জন্য যথেষ্ট ডরমিটরি নেই।যেইগুলো আছে তার অধিকাংশই মানুষ বসবাসের অনুপযোগী। টয়লেট নষ্ট,দেয়ালের প্লাস্টার খসে পরে।
এত এত নাই এর মাঝে ভাল কিছু ও আছে আর তা হলো এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় সব ঔষধ সাপ্লাই আছে, রোগীদের বাইরে থেকে তেমন কোন ঔষধ কিনতে হয়না। কিন্তু ফার্মাসিস্ট না থাকায় ঔষধ ঠিকমতো সংরক্ষণ করা যায় না।অধিকাংশ উপজেলায় স্টোর কিপার যারা তারা এইসব মেডিসিন সম্পর্কে কিছুই জানেনা তাই তারা বলতেও পারেনা কি কি ঔষধ সাপ্লাই আছে।
উপজেলায় পদোন্নতি ব্যতীত দুই বা তিন বছরের বেশি কাউকে ধরে রাখা উচিত নয়।এক সময় স্বাস্থ্য ক্যাডারে মেডিকেল অফিসার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে মেডিকেল অফিসার পদে থেকেই পেনশনে যেতে হয়েছে। এখন পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে।এই অবস্থার উন্নয়নের পিছনে বর্তমান সরকারের ভূমিকা প্রশংসনীয়। এখনো যেতে হবে অনেক দূর। অন্যান্য ক্যাডারের সাথে স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদোন্নতির বৈষম্য দূর করতে হবে। নিয়মিত পদোন্নতি দিতে হবে,উচ্চতর ডিগ্রি ছাড়া ও পদোন্নতি দিতে হবে। চাকরিতে যোগদানের চার বছর পরই যদি কেউ পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করে তাহলে তাকে অবশ্যই পদোন্নতি দিতে হবে।যদি পদ সংকট থাকে তাহলে অন্য ক্যাডারের মতো ইন সিটু পদেই পদোন্নতি দিতে হবে।
চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে,প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য সরকারি খরচে বিদেশে প্রেরণ করতে হবে। চিকিৎসকদের চৌকস, দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রশাসক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
উপজেলাকে গুরুত্ব না দিলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন হবেনা। দেশের গ্রামীণ জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।৬০-৭০% জনগণের বসবাস গ্রামে তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার মাধ্যমেই সম্ভব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন।