সম্প্রতি দেখা গিয়েছে যে ডাবল ভ্যাক্সিন নিয়েছে বা একটা ভ্যাক্সিন নিয়েছে কিন্তু তাও কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে, কিছু মানুষ মারাও গিয়েছে। এ নিয়ে কিছু কথা আমাদের বুঝা দরকার, বিশেষ করে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও মহামারির সময় নিয়ে।
১। ভ্যাকসিন নেয়ার পরেও কি কোভিড হতে পারে?
জি সম্ভব। ভ্যাকসিন দুই ডোজ নেয়ার পর আরো ১৪ দিন সময় লাগে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে। এর আগ পর্যন্ত কাউকে ভ্যাকসিনেটেড ধরা যাবে না। কিন্তু এই সময়ের পরেও কোভিড আক্রান্ত হতে পারে - যাকে বলা হয় ব্রেকথ্রু ইনফেকশান। এ নিয়ে বেশ গবেষণা হচ্ছে এখন।
২। ভ্যাকসিন কি তাও কার্যকরি?
আমি বারবার বলেছিলাম আগেও যে কোন কিছুই দুনিয়াতে ১০০% না, এটা সম্ভব নয়। অন্য অনেকে ১০০% বলেছিল যখন তখন ও আমি তাদের সাথে সম্মানের সাথে দ্বিমত করে বলেছি যে এটা সম্ভব নয়। এর উদাহরণ কিন্তু বাংলাদেশ নিজেও। বিসিজি টিকা অনেকের দেয়া হলেও যক্ষা এখনো হয়। কিন্ত যক্ষার কারণে হাসপাতাল সিস্টেম ব্রেকডাউন কিন্তু এখন আর হয়না। ওষুধ আর টিকা মিলিয়ে মোটামোটি ম্যানেজেবল একটা রোগে পরিনত করা হয়েছে। কোভিড ভ্যাকসিনও তাই - ১০০% কার্যকারিতা না দিলেও, অনেক কার্যকারিতা দেয়।
৩। কত পার্সেন্ট কার্যকরি এই ভ্যাকসিনগুলো?
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এক ডোজ টিকা দেয়া থাকলে (যেই টিকাই হোক) প্রোটেকশান কম দেখা গিয়েছে - ৩০-৩৫%। কিন্তু দুই ডোজ টিকা থাকলে হাসপাতাল ভর্তি ও মৃত্যু ঠেকানোর ক্ষেত্রে ৮০-৯৫% দেখা গিয়েছে বিভিন্ন গবেষনায়। আস্ট্রা-জেনেকা, মডার্না ও ফাইজারের ডাটা এসেছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডা থেকে। ইসরাইলি কিছু ডাটা আছে ফাইজার নিয়ে এবং চিলি থেকে আছে সাইনোফার্ম এর ডাটা।
৪। এই পার্সেন্টেজের মানে কী?
এই পার্সেন্টেজটা অনেক ডাক্তার, এমন কি একাডেমিকরাও ভুল বুঝেছে। ৯০% মানে এই না যে আপনার কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা ১০%। যখন এই গবেষনা করা হয়, তখন এক গ্রুপকে ভ্যাকসিন ও এক গ্রুপ কে ডামি দেয়া হয়। দুই গ্রুপের মধ্যে কম্পেয়ার করে যে কোন গ্রুপে কত জনের কোভিড হয়েছে। এবার ৯০% মানে কি?
ধরুন ১০০ মানুষের কোভিড হলো এই গবেষনায়। যদি ভ্যাকসিন ৯০% কার্যকরি হয় তাহলে এর ৯০ জন হবে যারা ভ্যাকসিন পায়নি এবং ১০ জন হবে যারা ভ্যাকসিন পেয়েছে। তাই এই সংখ্যা যদি বড় হতে থাকে, যেমন প্রতিদিন এক লাখ মানুষের কোভিড যদি হয়, এর ৯০% তথা ৯০,০০০ মানুষ ভ্যাকসিন পায়নাই। কিন্তু এর মানে এটাও যে ১০,০০০ মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েও আক্রান্ত হয়েছে। তাই কোভিডের বিস্তার হতে থাকলে ভ্যাকসিনেটেড মানুষের কোভিড হওয়ার খবর বাড়লেও, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা আছে। হাসপাতালে এখনো অধিকাংশ মৃত্যু হচ্ছে যাদের তারা কেউ ভ্যাকসিন পায় নাই।
অবশ্যই রিয়েল ওয়ার্ল্ড একটু ভিন্ন, কারন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন লেভেলের কোভিড সংক্রমণ হচ্ছে, এবং বিভিন্ন পার্সেন্টেজ মানুষেকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে।
এটা অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। যদিও দেশে মিজেলস এর বিরুদ্ধে বেশ অনেক মানুষের ভ্যাকসিন পাওয়া, তাও কার্যকারিতা ৯৪%, তাই সংক্রমণ বেড়ে গেলে কিছু ভ্যাকসিন পাওয়া বাচ্চাদেরও মিজেলস (হাম) হয়।
৫। ভ্যাকসিন দিয়ে কি সংক্রমণ কমানো যায়?
যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে ভ্যাকসিন দেয়া থাকলে, বাসায় সংক্রমণের হার ৪০-৫০% কমে আসে। তাই ভ্যাকসিন শুধু নিজের জন্যে সিরিয়াস রোগ প্রতিরোধ করেনা শুধু, অন্যের কাছে রোগ দেয়াটাও কমায়। তাই ভ্যাকসিন যত বেশি দেয়া যাবে সমাজে, তত সংক্রমণ কমে আসবে।
৬। ভ্যাকসিনেশান বাড়ালে কি মৃত্যুর হার কমে?
জি অবশ্যই। এই বছর যুক্তরাজ্যের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে মৃত্যুর হার কমে এসে এখন মাত্র ০.০৮৫%, যার কারণে ব্যাপক সংক্রমন হলেও হাসপাতাল গুলো ওভারলোড হচ্ছে না যেহেতু সিরিয়াস রোগী কমে এসেছে। উল্লেখ্য জানুয়ারির পিকে মৃত্যুর হার ২০ গুন বেশি ছিল (প্রায় ১.৫%)
তাইওয়ানের এক গবেষণায় আরো দেখিয়েছে যে, যদি ভ্যাকসিন কাভারেজ ১০% বাড়াতে পারেন জনগণের মধ্যে, তাহলে মৃত্যুর হার ৭.৫% করে কমতে থাকে। এটাই দেখা গিয়েছে যুক্তরাজ্যে যেখানে মৃত্যুর হার ১.৫% থেকে কমতে কমতে এখন ০.০৮৫% এ নেমে এসেছে।
৭। ভ্যাকসিন পাওয়ার পরেও কাদের কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?
- যে কোন দেশ যেখানে ব্যাপক সংক্রমণ হচ্ছে সেখানেই ব্রেকথ্রু ইনফেকশান হবে। তাই দেশে এখন সংক্রমের হার ৩০% এর কাছাকাছি হওয়ায় এমন হতেই পারে।
- অনেক মানুষের সমাগম যেখানে হয়, এস্পেশালি যদি মাস্ক পরা ও নিরাপদ দূরত্ব না বজায় রেখে মেলামেশা হয় তাহলে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি।
- স্বাস্থ্য-কর্মিদের ঝুঁকি বেশি যেহেতু অনেক অনেক পজিটিভ রোগীর স্পর্শে আসছে।
- যাদের বয়স ৬৫ এর বেশি।
- যাদের ইমিউন সিস্টেম কম কার্যকরি বিভিন্ন রোগের কারণে
৮। তো ভ্যাকসিন কি নেব? কোনটা নেব?
উপরে পার্সেন্টেজের হিসাব বোঝার পর বলতেই হবে যে প্রায় সব ভ্যাকসিনই কার্যকর। আস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না, সাইনোফার্ম যেটাই পাবেন, নিজেকে সুরক্ষিত করতে, পরিবারকে সুরক্ষিত করতে, সমাজে কোভিড কমিয়ে আনার জন্যে ভ্যাকসিন নিবেন। ভ্যাকসিন দেয়ার পর, শরীর এর একটা রিয়েকশান হয় যার জন্যে আমাদের কোভিডের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হয়*।
জুলাই এর ১৯ তারিখ পর্যন্ত ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের কোভিড হয়েছে যুক্তরাজ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারনে। এর ৮৭.৫% ভ্যাকসিন পায়নি। ভ্যাকসিনেশান যেখানেই বৃদ্ধি পাছে সেখানেই ব্যাপকভাবে মৃত্যুর হার কমছে। তাই নিজে নিন, অন্যকেও মোটিভেট করুন
Dr. Raiiq Ridwan
Specialty Registrar, Emergency Medicine
Cambridge University Hospital
Undergraduate Clinical Supervisor
University of Cambridge
*একজন নামকরা ডাক্তার বলে বেড়াচ্ছে যে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এন্টিবডি দেয়া হয়। এটা একদম ভুল কথা। ভ্যাকসিনে ভাইরাসের একটা অংশ আমাদের শরীরের কাছে পরিচিত করা হয়, যা দেখে আমাদের ইমিউন সিস্টেম এন্টিবডি তৈরি করে। পরে যখন করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে এই এন্টিবডিগুলো কাজে লেগে যায় যাতে ভাইরাস আমাদের শরীরে নিজের একটা স্থান করে না ফেলে৷
সংগৃহীত।