অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ; চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনোমিক রিসার্চ (এনবিইআর)
শিল্প কারখানা খোলার বিষয় নিয়ে অনেক প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রথমে মনে করেছিলাম সংক্রামণ রোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গার্মেন্টস মালিকদের ৫ তারিখ পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখতে রাজি করিয়েছিলেন। আমরাও ধরে নিয়েছিলাম যে, ৫ তারিখ পর্যন্ত গার্মেন্টস বন্ধ থাকলে অর্ডারের ঘাটতি কিংবা অর্ডার বন্ধ হবে না। পরবর্তীতে গার্মেন্টস মালিকেরা এই কথা উঠিয়ে নিয়ে আসলো এবং তারা সরকারকে পর্যাপ্তভাবে বুঝিয়েছে যে, ৫ তারিখ পর্যন্ত গার্মেন্টস বন্ধ রাখলে অর্ডারের পর অর্ডার বাতিল হতে পারে।
জীবন ও জীবিকা এ বিষয় নিয়ে আমাদের বন্ধু-বান্ধবগণ অনেক আবেগপ্রবণ কথাবার্তা বলেন। কিন্তু আমি এটাকে ইংরেজিতে যখন বলি সেটি হল, live and livelihood. এর একটাকে আরেকটা থেকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। live and livelihood হচ্ছে একটা পয়সার এপিঠ-ওপিঠ। তাই গার্মেন্টস বন্ধ রাখলেই যে সংক্রমণ বন্ধ থাকবে বা সংক্রমণ কমবে, আমি এটাতে বিশ্বাস করি না।
জনগণ হিসেবে আমরা দায়িত্বহীনভাবে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা এই দুই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উদযাপন করেছি। আমরা এমনভাবে দেশের প্রতিটি স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছি, যেন আর না গেলেই নয়, যেন বাবার জানাজা পড়তে যাচ্ছি, যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে যদি এক জায়গায় থাকি। এতে উচ্চ সংক্রমণশীল করোনার ভ্যারাইটির ব্যাপক চাষাবাদ করেছি আমরা।
গার্মেন্টস খুলে দিলে যে মৃত্যু অনেক বাড়বে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু যেটা বলতে হয়, আমরা গার্মেন্টস মালিকদের ওপেন জেনারেল লাইসেন্স দিতে পারি না। আমরা দেখেছি গার্মেন্টসের মালিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গার্মেন্টস চালাবে বললেও অনেক সময় সেটা চালায়নি। তাই এখন আমার অনুরোধ থাকবে, গার্মেন্টস মালিকরা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালান।
গার্মেন্টস মালিকদেরকে সতর্ক করে বলতে চাই, আপনারা যেভাবে অনুনয় বিনয় করে গার্মেন্টস খোলার কথা বলছেন, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য কারখানা খুলে দেওয়া বিপক্ষে আমরা অবস্থান নিচ্ছি না; কিন্তু আপনারা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই চার মিলিয়ন গার্মেন্টসকর্মীকে টিকা দিয়ে দিবেন। কারণ তাদের প্রায় সবার কাছেই জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। এতে ২ বা ১ ঘন্টা কাজের ক্ষতি হলেও আপনারা এটা অবশ্যই করবেন। এবং সামাজিক দূরত্ব আরো বাড়ানোসহ সবাইকে মাক্স পরতে বাধ্য করবেন। আপনারা যে মাক্স বানাচ্ছেন সেই মাস্ক আমরা পরছি, সেই মাস্ক দেশে-বিদেশে সকলে পরছে, সকল জায়গায় রপ্তানি করা হচ্ছে কিন্তু সেই মাক্স যারা বানাচ্ছেন তারা না পরলে তাদের একটা জীবন বরবাদ হলে খোদার কাছ থেকে আপনারা দায় মুক্তি পাবেন না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেকটা বিষয় খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করার নজির পৃথিবীতে খুব কম আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেটিরও ব্যবস্থা করেছেন। সবাই যেন ভ্যাকসিন দিতে পারে সেই সুযোগ তিনি আমাদেরকে করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে কিছু অতি বুদ্ধির লোকজন আছেন তাদের কর্মকাণ্ডকে আমি কোনোভাবেই সমর্থন করছি না। যদিও তারা আমার কথায় রাগ করতে পারেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, গার্মেন্টস যদি ১ তারিখ থেকে খুলে দিবেনই তাহলে সেটা ২৬ তারিখে ঘোষণা দিলে গার্মেন্টসে যারা চাকরি করে তাদেরকে খণ্ড খণ্ডভাবে ভেঙে ভেঙে আসার সুযোগ করে দেওয়া যেত। কি কারণে সরকার গণপরিবহন বন্ধ রেখেছে এটা আমরা জানি। এটা নিয়ে যারা প্রশ্ন করছেন তারা হয়তোবা এটা অতটা বুঝতে পারছেন না। কারণ গণপরিবহন খুলে দিলেই একদম টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া মুভমেন্টের কারণে সংক্রমণ সারা দেশে আরও বেশি করে ছড়িয়ে যাবে। কিন্তু ১ তারিখ ফ্যাক্টরি খুলে দেওয়া হবে আবার এটা ৩০ তারিখ বলবেন ২৯ তারিখ জল্পনা-কল্পনা হবে। গার্মেন্টসের শ্রমিকরা গিনিপিগ নয়, এরা আমাদেরই মা, বোন, ভাই, বাবা। এদেরই সন্তানরা অনেকে আজকে আপনারা সচিব হয়েছেন। তাদেরকে এভাবে শারীরিক কষ্ট দেওয়ার কোন দরকার ছিল না। সিদ্ধান্ত হয়েছে এটা খুব ভালো হয়েছে যদিও আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি হয়েছে। যেটা ২৮, ২৯ তারিখ করতে সেটা ৩০ তারিখ হয়ে গিয়েছে, তাহলে এটা ১ তারিখের জায়গায় ২ বা ৩ তারিখ খুললে কি হত।
এই ধরনের সমন্বয়হীনতামূলক সিদ্ধান্তের কারণে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে, অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে, শিল্প-কারখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক মস্তিষ্কহীনতা মেধাহীনতা ফুটে উঠেছে।
সময় জার্নাল/এসএ