অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ; চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনোমিক রিসার্চ (এনবিইআর)
বর্তমানে করোনা সংক্রমণের যে ঢেউ এসেছে এটি কিছুটা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর যে সব দেশে সংক্রমণ কিছুটা কমে এসেছিল সেখানেও এখন কড়াকড়ি চলছে। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি হলেও লকডাউন কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে না।
লকডাউন আসলে কোনো স্থায়ী সমাধান নয়, কারণ মানুষের পেটে লকডাউন করা যায় না। তাহলে উপায় কি? যদি লকডাউন বাড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে আমাদের কোটি কোটি লোক বেকার হয়ে যাবে। এই লোকগুলোর যদি চাল ডাল তেল নুন মরিচ ছাড়া তাদের কাপড়-চোপড় জুতা স্যান্ডেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয় ক্ষমতা হারায় তাহলে আমাদের অর্থনীতি এবং সবগুলো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, এবার কোরবানিতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ছিল না এবং অনেকে কোরবানি দিতে পারেন নাই, যার কারণে অনেক গরু বিক্রি হয়নি।
করোনা হচ্ছে- জীবন, অর্থনীতি ও সভ্যতা বিনাশী। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বপ্রথম আমাদের অর্থনীতিকে আবার সচল করতে হবে। এজন্য ইতোমধ্যে গার্মেন্টসগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। গার্মেন্টস খুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে আমরা যেতে পারছি না, কারণ এখানে ৪০ লাখ কর্মীসহ আরো ৩ কোটি মানুষের পেটের জ্বালা জড়িত। কিন্তু যে বিষয়টির সমালোচনা না করে পারছি না সেটা হলো, সবখানে একটা সমন্বয়হীনতা দেখছি।
যদি ১ তারিখে কারখানা খোলা হয় তাহলে ২৭ তারিখ থেকে ৩ দিনের সময় দিয়ে বলা যেত যে, আপনারা ভেঙে ভেঙে আসেন। যেহেতু দূরপাল্লার বাস এবং গণপরিবহন চলছে না। যদি সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ৩০ বা ৩১ তারিখ হয়ে যায় তাহলে খোলার তারিখ ৩ আগস্ট হতে পারত। আমাদের শ্রমিকদেরকে পায়ে হাঁটিয়ে মা-বোনদেরকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার দরকার ছিল না। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই গার্মেন্টসের জনতা, কৃষক-শ্রমিকদের থেকেই আজকে আমরা প্রফেসর হয়েছি, সচিব হয়েছি। ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না।
মহামারীতে একটা মৃত্যুও কাম্য নয়। কিন্তু প্রতি মিলিয়নে (দশ লাখ) মৃত্যুর হার চিন্তা করেন। আমাদের ডাক্তাররা তাদের নির্ঘুম পরিশ্রম, অক্লান্ত খাটুনি এবং আমাদের দেশের মানুষের ইমিউনিটি সিস্টেম শক্তিশালী হওয়ায় প্রতি মিলিয়নে মৃত্যুর হার অনেক কম।
দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ রাখা যায় না। আমাদেরকে একটা সমাধানে আসতে হবে। এজন্য আমাদের করোনা সেইফ লাইফস্টাইল, করোনা সেইফ উৎপাদন ব্যবস্থা, করোনা সেইফ গভর্নেন্স লাগবে। কিন্তু দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলতে হয়, আমাদের এখানে করোনা সেইফ গভর্নেন্স নেই। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো, যখন গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হবে তখন শ্রমিকদেরকে ৭২ ঘন্টা সময় পর্যন্ত দেওয়া হয়নি ভেঙে ভেঙে আসার জন্য। আরও বলতে চাই, আমরা মাক্স এবং পিপিপিই রপ্তানি করছি এবং নিজেরাও পরছি। কিন্তু গার্মেন্টসের শ্রমিকরা মাস্ক পাচ্ছে না, আবার পরছেও না।
গার্মেন্টস মালিকদের অনুরোধ করে বলতে চাই, আগুন নিয়ে খেলা উচিত নয়। আপনাদের অনুরোধে সরকার গার্মেন্টস কারখানা খুলে দিয়েছে এটা দেশের অর্থনীতির জন্য অনেক বড় সুখবর। এখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পরিবেশে কাজ করার টেবিলগুলো ডিস্টেন্স রেখে বসাতে হবে, সবাই যাতে মাস্ক পরে সেটা নিশ্চিত করতে হবে এবং শ্রমিকদের জন্য মেডিকেল সুরক্ষা জোরদার করতে হবে। কারণ আমরা আমাদের অর্থনীতিকে লকডাউন করতে পারব না, পেটকে লকডাউন করা যায় না।
করোনার ডেল্টা ভ্যারাইটি থেকে আগামী ১ বছরেও মুক্তি পাব কিনা সন্দেহ রয়েছে। এ অবস্থায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এভাবে ফেলে রাখা যাবে না। তাই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে ভ্যাকসিন দিয়ে ধীরে ধীরে আবার সব খুলতে হবে। আমাদেরকে আস্তে আস্তে কাজ করতে হবে এবং করোনা সেইফ লাইফ স্টাইলে যেতে হবে৷
এখন করোনা নিয়ে এতটা ভয় পাচ্ছি না। কারণ অসাধ্যটা সাধন করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তিনি আমাদের জন্য চার পাঁচ ধরণের টিকা সহজলভ্য করেছেন। এখন গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অর্থনীতি বাঁচানোর আগে জীবন বাঁচাতে হবে। এজন্য প্রথম কাজ হচ্ছে সবার টিকা গ্রহণ। পাশাপাশি মাস্ক পরতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে।
ইতোমধ্যে করোনা ১ কোটি মানুষকে কর্মচ্যুত করেছে, সেই মানুষগুলো গ্রামে চলে গেছে। এখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে ফান্ড বাড়াতে হবে। গ্রামের প্রত্যেকটা পুকুরকে ফিস ফ্যাক্টরিতে রুপান্তর করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, ‘সব ফাঁকা জায়গা আবাদ করে ফসল ফলাতে হবে, এক ইঞ্চি জমিও ফাঁকা রাখা যাবে না।’
এই মুহুর্তে সরকারি দল ও বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমূহকে মিলে একসাথে ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত সব জায়গায় মানুষকে টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। জীবন বাঁচানোর জন্য সকলকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
টিকার কার্যকরীতার ব্যাপারে গ্লোবাল স্ট্যাটিসটিকস যেটা আমার হাতে রয়েছে সেটা হচ্ছে, মার্কিন মুলুকে এবং ইউরোপে বলা হচ্ছে, যারা টিকা নিচ্ছেন তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন ৯০ শতাংশ কমে যাচ্ছে, করোনা হলেও বাসায় সুস্থ্য হয়ে উঠছে। টিকা যারা দিয়েছেন তাদের মধ্যে মৃত্যুহার নেই বললেই চলে, ৯৮ শতাংশ মানুষই বেঁচে যাচ্ছেন। তারপরও আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের হাসপাতালগুলোতে যারা ভর্তি হচ্ছে তারা সবাই টিকা না নেওয়াদের দলের।
আমাদের দেশ কৃষি নির্ভর দেশ। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি বিনিয়োগ বাড়ালে আমরা অর্থনৈতিক বাঁধা অতিক্রম করতে পারব। এটা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের শহরের এক কোটি মানুষ চাকরিচ্যুত হয়ে গ্রামে চলে গেছে। তাদের জন্য নতুন করে চাকরি সৃষ্টি করতে হবে। এটা একটা চ্যালেঞ্জের কাজ। সেটা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী সবার সাথে আলাপ আলোচনা করে করবেন।
বেঁচে থাকাটাই এখন মূখ্য। আমার না হয় পাঁচ বছরের জীবিকা সঞ্চয় করা আছে, কিন্তু যারা জানে না রাতে কি খাবে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে এই শিল্প কারখানার কার্যক্রম এবং করোনা পরবর্তী অর্থনীতি সাজাতে হবে।
সর্বশেষ বলতে চাই, আমাদের এই ৪০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকদের যত দ্রুত সম্ভব টিকা দিয়ে দিতে হবে। তাহলে করোনা হলেও হাসপাতালে যেতে হবে না এবং মৃত্যু ঝুঁকিও থাকবে না।
সময় জার্নাল/এসএ