শান্তা মারিয়া : ঢাকায় বাইজিদের বেশ জমজমাট দাপট এবং টাকা পয়সা ছিল মোগল আমল থেকেই। মোগলরা যখন ঢাকার ছোট জনপদকে সুবে বাংলার রাজধানী করে তখনও এখানে নৃত্যগীত পারদর্শী কিছু নারী ছিলেন। তবে সোনারগাঁও এবং এর আশপাশের এলাকাতেই তাদের বসবাস বেশি ছিল কারণ সুলতানি আমলে সেটাই ছিল রাজধানী।
ঢাকায় এবং তার আশপাশের গ্রামে কিছু গান বাজনা ও নাচের দল ছিল। বেদে সম্পদ্রায়ের নারীরাও নৃত্যগীত পরিবেশন করতেন। তবে ঢাকা যখন সুবে বাংলার রাজধানী হলো তখন দিল্লির বাদশাহী দরবার থেকে নৃত্যগীত পটিয়সী নারী এবং ওস্তাদ ও বাজনদারদের দলকে ঢাকায় পাঠানো হয়। নইলে মোগল দরবার ছেড়ে আসা সুবেদারদের মনোঃকষ্টে ভোগার আশংকা ছিল। শুধু ক্ষমতায় কি আর পুরুষের পেট ভরে না মন ভরে? চক মোগলটুলির কাছাকাছিই গড়ে ওঠে বাইজিপল্লী। পাটুয়াটুলি ও জিন্দা বাহার লেনেও বাইজিদের বসবাস ছিল।
ঢাকার নায়েবে নাজিম এবং নবাবদের দরবারেও বাইজিদের কদর ছিল ভালোই। মোগল আমলে রমনার বাগানে বা অরণ্যে জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে যখন বন ভোজনে যেতেন মোগলরা তখন বাইজিরাও থাকতো সঙ্গে। শাহবাগের নাচঘরে(বর্তমানের মধুর ক্যান্টিন) বাইজিরা নাচ পরিবেশন করতেন। নিমতলীর প্রাসাদ এবং আহসান মঞ্জিলের নাচ গানের আসর ছিল পুরো ঢাকায় মশহুর।
ঊনবিংশ শতকে অচ্ছন বাই, ছোটি বেগম, আন্নুবাই, গান্নু বাই, নওয়াবীনবাই, রাজলক্ষ্মীবাই, আমীরজানবাই, গওহরজান, মালকাজান, দেবীবাই, নিচুয়াবাই, এমন হরেক নামের নৃত্যগীত শিল্পী ঢাকায় ছিলেন। নামী দামী বাইজিরা যথেষ্ট ধন সম্পদেরও মালিক ছিলেন। তাদের নিজস্ব বাড়ি, বাগান, জুড়িগাড়ি ইত্যাদি ছিল। একেকজনের অলংকারপাতিও ছিল চোখ ধাঁধাঁনো। হীরা, চুনী, পান্না বসানো সোনার অলংকার পরতেন তারা। পোশাক ছিল কামিজ ও ঘাগড়া। শাড়িও পরতেন। তাদের পোশাকও ছিল দামী। বাইজিরা অনেকে এসেছিলেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে। দিল্লি, লাখনৌ, গোয়ালিয়র, কাশী, বারানসী থেকে অনেকে আসেন। বাঙালিও ছিলেন।
বাইজিদের সামাজিক মর্যাদাও ছিল। হয়তো অভিজাত পরিবারের কুলবধূ তারা হতে পারতেন না বা হতে চাইতেনও না, কিন্তু দরবার, রাজনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদিতে তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ব্যবসায় মালিকানাও ছিল। অনেক দান খয়রাতও তারা করতেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করতেন। কোন উচ্চ বংশের পুরুষ বাইজিকে বিয়ে করতেন না সেটা ঠিক। কিন্তু সেজন্য বাইজিদের যে খুব আফশোস ছিল নাও নয়। টাকা পয়সা, বাড়িঘরের মালিকানা ও স্বাধীন জীবন ছেড়ে কেই বা সাধ করে মহল-বন্দিনী হতে চায়।
তবে বাইজিরা কিন্তু দেহ পসারিনী বা সরাসরি যৌনকর্মী ছিলেন না। তারা বহুগামী ছিলেন সেটা ঠিক। কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা স্বাধীন ছিলেন। অনেক ধনীর প্রেমিকা তারা হতেন। আবার চাইলে কাউকে প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব প্রেমিক গ্রহণ করতে পারতেন নিজের খুশিমতো। রূপসী বাইজিদের একটু নেক নজর পাওয়ার জন্য অভিজাত বা অনভিজাত অনেক পুরুষ ঘুরঘুর করতো।
সাধারণ যৌনকর্মীরা কিন্তু চিরদিন বঞ্চিতই ছিলেন। তাদের নৃত্যগীতের পারদর্শিতা ছিল না। তারা অত্যাচারিতও হতেন। ঢাকায় বাইজি পাড়ার সঙ্গেই সাধারণত থাকতো ব্রোথেল। বিংশ শতকে বাইজিদের দাপট কমে যায়। ঢাকার প্রথম যুগের থিয়েটার শুরু হলে অনেক বাইজি মঞ্চশিল্পী হিসেবে চলে যান। সিনেমা থিয়েটার শুরু হলে বাইজিদের নাচগানের প্রতি আগ্রহও মানুষের কমে যায় এবং বিনোদনের জন্য তারা সিনেমা হল, থিয়েটার এমনকি যাত্রার দিকেও ভিড়ে পড়ে।
ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জের টান বাজার আর টাঙ্গাইলের ব্রোথেল বিশাল বড়। দৌলতদিয়া ঘাটও প্রকাণ্ড। ঢাকার কাছাকাছি গঞ্জে (মানিকগঞ্জ, মদনগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ) যৌনকর্মীরা থাকতেন।
ঢাকার ভিতরে অত বড় ব্রোথেল কখনও ছিল না। ঢাকায় জনসন রোড, ইঙ্গলিশ রোড, মালীটোলা, কান্দুপট্টি ইত্যাদি জায়গায় ছোট ছোট ব্রোথেল ছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লটমন জনসন সাহেবের নামে জনসন রোড বিশ শতকের প্রথমে ঢাকার কমিশনার ইঙ্গলিশ সাহেবের নামে ইঙ্গলিশ রোডের দোতলা বা তিনতলা বাড়িতে যৌনকর্মীরা থাকতেন।
কবি শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা ‘মাতোয়ালা রাইত’ কান্দুপট্টিকে অমরত্ব দিয়েছে। কান্দুপট্টিতেও যৌনকর্মীরা থাকতেন। সাধারণত ব্রোথেলের সামনে বা গলির মোড়ে সন্ধ্যা হলেই বেলী ফুল বিক্রি শুরু হতো। ওইসব পাড়ার মুদির দোকানে পান, বিড়ি তো বিক্রি হতোই তারসঙ্গে আবগারীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে মদের বোতলও মিলতো। মুদি দোকানে অথবা পাশের মনোহারী দোকানে থাকতো জরির মালা, আলতা, সস্তা পাওডার, অতি সস্তা পারফিউম বা আতর। বিশ শতকের যৌনকর্মীরা সস্তা রুজ লিপস্টিকও মাখতেন।
সন্ধ্যা হলেই পাড়ার মোড়ে অথবা যার যার বাড়ির সামনে তারা দাঁড়িয়ে থাকতেন রোজগারের প্রত্যাশায়। এসব পাড়ার ভিতরে সব বাড়িই যে যৌনকর্মীদের ছিল তা কিন্তু নয়। অন্যান্য পেশার মানুষও সেখানে থাকতেন। সাধারণত গরিব কেরানী, কোর্টের পেয়াদা, দরিদ্র উকিল, পেশকার, মুহুরী, দোকানদার, দোকান কর্মচারী এরা এসব বাড়িতে পরিবার নিয়ে বাস করতেন। তাদের বাড়ির গায়ে আলকাতরা বা চকখড়ি দিয়ে লেখা থাকতো ‘ইহা ভদ্রলোকের বাড়ি’।
এমন একটা বাড়ি দেখেছিলাম খুব ছোটবেলায়। তখন নয়-দশ বছর বয়স হবে। রিকশায় করে যাচ্ছি বাবা,মায়ের সঙ্গে। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম।
আমাদের রিকশাওয়ালা চেষ্টা করছে জ্যাম এড়িয়ে গলি ঘুঁচির ভিতরে সর্টকাটে যাবার। এক গলি থেকে অন্য গলির ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে ঢুকে পড়েছে এমনি একটি পাড়ার ভিতরে। বোধহয় জনসন রোডের কোন শাখা অথবা মালীটোলা ছিল সেটি। সেই গলির ভিতরে ঢুকতেই শুনলাম বাবা রিকশাওয়ালাকে ধমক দিয়ে বলছেন, ‘এখানে ঢুকলা কিসের জন্য?তাড়াতাড়ি অন্য রাস্তায় যাও’
বাবার রাগ করা বা রিকশাওয়ালাকে ধমক দেয়া একটা বিরল ঘটনা। আমি সেজন্য খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কোন জায়গা?’ বাবা কোন জবাব দিলেন না। মা বললেন, ‘এখানে চোর ডাকাতরা থাকে তো তাই এখানে আসা ভালো হয়নি।’
এদিকে জ্যাম এড়ানোর জন্য এই গলিতে ঢুকেও রিকশা জ্যামেই পড়েছে। আমার অভ্যাস ছিল সবকিছু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করা। দেখলাম সাজগোজ করে, চুলে জরি ফিতা বেঁধে কয়েকজন নারী রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেশ হাসি তামাশা করছেন। বেলী ফুল বিক্রি হচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা একটি একতলা পুরনো বাড়ির দরজায় লেখা ‘ইহা ভদ্রলোকের বাড়ি, ধাক্কা দিবেন না’। লেখাটা দেখে খুব মজা পেলাম। কারণ বাড়ি তো ভদ্রলোকেরই হবে। অভদ্রলোকের বাড়ি আবার কোনটা? ভদ্রলোকের বাড়ি আবার আলাদা করে লেখার দরকার পড়ে নাকি? আবার আমার প্রশ্ন, ‘ওই বাড়ির লোকরা কি বোকা দেখো, লিখে রেখেছে ভদ্রলোকের বাড়ি। অন্যরা কি তাহলে অভদ্র লোক’।
বাবা মৃদুস্বরে বললেন, ‘ওরা মজা করে এসব লিখেছে। থাক তুমি একটু চুপ করে থাকো এখন, রাস্তায় এত কথা বলতে হয় না।’ একটু পর রিকশা ওই গলি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় বাবা, মা দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
ঘটনাটা আমার উপর বেশ ছাপ ফেলেছিল। কারণ বাবা রাগ করছেন, আমার কথার সন্তোষজনক উত্তর দিচ্ছেন না এবং আমাকে চুপ করতে বলেছেন তিনটিই বিরল ঘটনা।
এই ঘটনার অনেক বছর পরে জনকণ্ঠে ‘আমি ঢাকাইয়া’ সিরিজ রিপোর্ট এবং যৌনকর্মীদের নিয়ে ফিচার লেখার সময় পুরো ঘটনাটি স্মৃতিতে ফিরে আসে এবং ‘ইহা ভদ্রলোকের বাড়ি’র মাজেজা অনুধাবন করতে পারি। অবশ্যই এখানে বলতে চাই যৌনকর্মীরা ‘অভদ্রলোক’ আর যৌনকর্মী না হলে ‘ভদ্রলোক’ এই ধরনের নেতিবাচক ও অমানবিক চিন্তা আমি কখনও ধারণ করি না।
সত্তর ও আশির দশকে ঢাকার রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানেও যৌনকর্মী খুব কমই দেখা যেত। বিকেল বেলা পার্কে বেড়ানো তখন ছিল মধ্যবিত্তের বিনোদন।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সময় জার্নাল/আরইউ