শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪

দেহের বয়স বাড়ে, মনটা তো বাচ্চা হয়েই পড়ে থাকে মায়ের কোলে!

শুক্রবার, আগস্ট ৬, ২০২১
দেহের বয়স বাড়ে, মনটা তো বাচ্চা হয়েই পড়ে থাকে মায়ের কোলে!

ডা. ফাতিমা খান :

আমার মা আমাকে একেক সময় একেক নামে ডাকেন।
হয়ত আমি অফিস থেকে বাসায় এসেছি, ফোন করে বলবেন,
- তুফান, বাসায় আসছিস?
অনেক ক্লান্তিতেও হাসি আসত। তুফান আবার নাম হল?
- না, তুই বাসায় আসলেই তো ঘরদোর কাঁপায়ে ফেলিস! যেভাবে দৌড়ে দাপটে ঘরের কাজে লেগে যাস আমার তো দেখলেও মাথা ঘুরে, মনে হয় তুফান আসছে!
- ধুর! কি যে বলেন আম্মা!
উইকেন্ডে হয়ত বাসায় গিয়েছি। আম্মা আর্থ্রাইটিসের দূর্বল পা হেচড়ে হেলে দুলে দরজায় আসবেন। হাসি দিয়ে বলতেন,
- খানের বেটি আসছিস? নে, আমার ঘরটা উজালা হইল।
এমন নয় যে অনেকদিন পর মায়ের বাসায় গিয়েছি, তারপরও মনে হত উনি কতকাল যেন আমাকে দেখেননি।
পুরা সপ্তাহের জমিয়ে রাখা আমার আর উনার নাতিদের পছন্দের নানা রকম খাবার তৈরির কাজে লেগে যেতেন। ডাক্তারসাব যে কয় বছর জেদ্দাতে ছিল, মায়ের বাসায় গেলে ডাইনিং টেবিলটার কোন কোণা ফাকা থাকত না। মেন্যু হত জামাই এর পছন্দের সব খাবার দিয়ে। আকাশের বাপের দোকানের ( বাংলাদেশি মাছের দোকান) সাত কেজি কাতলা মাছ, ছোট মাছ, মাংস, ভাজি, ভর্তা, আচার, মিষ্টি, - কোনটা না থাকত !
মাঝে মাঝে তাকে বলতাম,
- তুমি কি আজীবন নতুন জামাই- ই থাকবা?
আম্মা আমার কথা কেড়ে নিয়ে বলতেন,
- তুই চুপ কর, আমার একটা মাত্র জামাই!
আমার ছেলেদের পছন্দের খাবারই শুধু না, তারা কোন মাছ, কোন মাংস কিভাবে রান্না করলে দুই নলা বেশি খাবে তা উনার খুব জানা, ইন ফ্যাক্ট মা হিসেবে আমি এখনও অতটা জানিনা।
একদিন আম্মার পায়ের ব্যাথাটা অনেক বেশি। দুই হাটু ফুলে একাকার। অফিস থেকে এসে বাসায় ফোন দিলাম। আব্বু বললেন,
- তোর দুই ছেলেকে পাঠায়ে দে, দেখবি পায়ের ব্যাথা ভাল হয়ে যাবে। নাতিদের জন্য চিকেন রোস্ট আর হান্টার বিফ করতে উঠে দৌড়াবে।
সত্যি সত্যি আমার দুই ছেলেকে পেলে আমার অসুস্থ বাবা মা কে দেখতাম সুস্থ হয়ে গেছে!
বাচ্চারা স্কুল শেষে নানার বাসায় চলে যেত। একটু জিরিয়ে, দুপুরের খাবারটা সেরে বাসায় ফিরত৷ ওদের স্কুল ব্যাগে করে কতদিন যে আম্মা একটু তরকারি পাঠিয়ে দিয়েছেন তার হিসেব নেই। রাগ করতাম, ভীষণ রাগ করে বলতাম,
- আম্মা প্রতিদিন দিয়েন না তো! এই অসুখে বিসুখে আপনাকে কে করে খাওয়ায়? আমি সুস্থ মানুষ আমাকে রেঁধে খাওয়ানো লাগবে?
- তুই সারাদিন যেই পরিশ্রম করিস, আমি একটু কিছু পাঠাইলে তো তুই হাতটা ধুয়ে খেতে বসতে পারিস! তোরে না দিয়ে তো আমার খেতে ভাল লাগে না।
এখন তো মায়ের হাতের একটু রান্না খেতে পরান টা আনচান করে, পাই না!
মা কিন্তু ঠিকই বলতেন - কাছে আছিস যতদিন দুইটা রেঁধে দেই, দূরে চলে গেলে তো আর তোরে পাব না!
ঈদ-চাঁদ, জন্মদিন বা অন্য কোন উপলক্ষের দিন তারিখ আমি ভুলে গেলেও মা ভুলেন না। ঠিকঠিক আমার বাবাকে বলে পয়ত্রিশ কিলোমিটার ড্রাইভ করিয়ে আমার জন্য উপহার নিয়ে উপস্থিত হতেন। আমি রাগ করতাম,
- মা, আব্বুর এখন ড্রাইভ করা ঠিক না, কেন শুধু শুধু এত রাত করে আসেন?
এই নিয়ে কতদিন যে আব্বুর সাথে রাগ করেছি! অফিস থেকে বাসায় আসতাম রাত দশটায়। আমাকে একটু দেখার জন্য আব্বু প্রায়ই রাত দশটার পর আমার বাসায় আসতেন। আব্বুকে বিদায় দিতে খুব টেনশন লাগত, এত রাতে গাড়ী চালিয়ে এসব পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে বাসায় যেতে পারবেন তো!
আব্বু হাসিমুখে বিদায় নিয়ে বলতেন, চিন্তা করিস না, তোর বাবা ever young man!
তাতো বটেই! ছেলে,মেয়ে, নাতি নাতনিদের জন্য তিনি সত্যি একজন ever young man. এখন পর্যন্ত কোন সমস্যায় বাবাকেই কল দেই, আমার ছেলেরাও তাদের যাবতীয় অভাব অভিযোগ নানাভাইকেই আগে জানায়।
গতবছর এসময় আমি জেদ্দায়। আমার জন্মদিনে মা ফোন করে বলছিলেন,
- কিরে লাডলি! বাসায় আসতেছিস তো?
- না আম্মু, ভাল লাগছে না।
- ওমা, জমিদারের নাতনি বলে কি? আজকে না তোর জন্মদিন! আমি সারাদিন রান্নাবান্না করলাম, তুই এসে খালি সালাদটা কাটবি। তোর বাপকে পাঠাচ্ছি, রেডি হয়ে থাক।
মায়ের মত এত অসীম ধৈর্যের অধিকারী হতে পারিনি। রসায়নের ছাত্রী আমার মা রসায়নে ক্যারিয়ার না গড়লেও পরিবার ও সম্পর্কের রসায়নটা ষোল আনা প্রয়োগ করেছিলেন আমাদের জীবনে। আমার ছেলেদের ভাষ্য হল আমার থেকে ওদের নানুমনি নাকি more kind and patient.
আমার মত ভাগ্যবতী মানুষ দুনিয়াতে কয়জন আছে জানিনা। আমার সত্তুরোর্ধ বাবা আমাকে এখনো বাচ্চা মেয়েটার মত আদর আহলাদ দিয়ে কথা বলেন। আমার অসুস্থ মা একটা দিন কথা না হলে অস্থির হয়ে যান। মৌসুমী ফলগুলো খাচ্ছি কিনা খবর নেন, ঠান্ডা কিছু যেন না খাই, বেলা করে যেন গোসলে না যাই তাগিদ দেন। গলার স্বরটা একটু ভারী শোনালেই উপদেশের ঝুড়ি উল্টে দেন, আবার ফোন করে ফিডব্যাক নেন উনার ঘরোয়া টিপস গুলোতে আমি উপকার পেলাম কিনা। আমি চুপ করে থাকি।
মা তো জীবনযাপনের ছোট থেকে বড় সব কৌশলই শিখিয়ে দিয়েছেন, শুধু তাদের স্নেহাস্পর্শ ছাড়া কেমন করে দিনযাপন করতে হয় সেটাই শেখাননি। অকারণ অপবাদ, অবহেলা, কষ্ট গুলো কি করে হজম করতে হয় তা শেখাননি। মা কখনো আমাদের শেখাননি কিভাবে দুষ্টের প্রতিবাদ করতে হয়, চিৎকার করে কথা বলতে হয়। গালিগালাজ শুনিনি মায়ের মুখে। মা আমাকে বলে দেননি পৃথিবীটা তাদের ভালবাসা ঘেরা জগৎটার মত এত মায়াবী নয়, এখানে পাজরে পাথর বেঁধে চলতে হয়।
আমার আসলে এখন কিছুই ভাল লাগেনা। মা বাবাকে কি করে বলি যে মনটাকে জিইয়ে রাখার কোন টোটকা আছে কি ?
( মা বাবা ফোন করে মনে করিয়ে দিলেন কাল আমার জন্মদিন। আব্বু বলেছেন আমি যেন নিজেই মজাদার রান্না করে সবাইকে নিয়ে খাই। অনেক দোয়া করে দিলেন। মা কাঁদছেন অঝোরে, আমার জন্য নাকি বাড়তি দুরাকাত নামাজ পড়ে দোয়া করবেন। আমার দেহের বয়স বাড়ে, মনটা তো বাচ্চা হয়েই পড়ে থাকে মায়ের কোলে!)


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল