মঈনুদ্দিন মানু :
১৯৫৪ সালের ০১ মার্চ জন্ম নেয়া ডাক্তার নাসির ৫-৬ বছর বয়সে ভর্তি হন কাংশা ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে।কাংশা ফ্রি প্রাইমারী সরকারী স্কুলেই তাঁর পড়ালেখার হাতে খড়ি।
দাদা হেলাল মাদবর ছিলেন সিঙ্গাইর-ধামরাই অঞ্চলের সালিসি বৈঠকের কিংবদন্তি বিচারক।
প্রখর মেধা-বুূ্দ্ধি-জ্ঞানে সাহসিক সিদ্ধান্তই ছিলো তার অস্ত্র। তাঁর বৈঠকি বিচারদেখা ছিলো আমার ছোটবেলার এক স্মরণীয় অতীত।
ডাক্তার নাসিরের মধ্যে দাদা'র বিচক্ষণতা আর বিদ্যা-বুদ্ধির স্ফুরিত আভা'র আভাস পেলো ডাক্তার নাসিরের বাবা আব্দুর রশিদ।
তাইতো আব্দুর রশিদ ছেলে নাসিরের মধ্যে সুপ্ত মুক্তোমনির সন্ধান পেয়েই নাসিরকে তাঁর খালার সাথে ১৯৫৮ সালের কোন এক মাসের শুভ্রসকালে লেখাপড়ার জন্য পাঠালেন কাংশা'র ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে।
শৈশবের শ্লেটপেন্সিল,খেজুরের ডাল কিংবা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কলাপাতায় লেখা শিশুটি লম্বা এক টিনের চালের প্রাইমারী স্কুল শেষ করে ১৯৬৩ সালে সিক্সে ভর্তি হলো সিঙ্গাইর বাইলেটারাল উচ্চ বিদ্যালয়ে।
ইতোমধ্যে প্রাইমারী স্কুলেই তাঁর তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় পেল শিক্ষক-গুরুজনেরা। ছাত্রের প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত মেধার খবর শুধু কাংশার আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীই জানলো না-পাশ্ববর্তী খড়ারচর তালেবপুর, রোয়াইল, সিঙ্গাইর, আটিমাইঠান,
বহুতকূল, ধল্লা, জয়মন্টপ, গাজিন্দা, আজিমপুর, রৌহা, রৌহারটেক, গোলড়া, গোবিন্দল, ঘোনাপাড়া, সুয়াপুর, পেটকাটা, ইরতা, বারতা, বায়রা, কাইমতারা, কৃষ্ণনগর এমনকি আমাদের গ্রাম কুরুঙ্গী ছাড়াও জানলো অত্র বিস্তীর্ণ অধ্যুসিত এলাকার সকলে।
ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় মানিকগঞ্জ জেলায় মেধা তালিকায় নাসির প্রথম এবং ঢাকা বোর্ডে ৯ম হলে সকলে তাঁর মেধার স্ফুরণে ধন্য ধন্য করলো। নাসির উদ্দিন আহমেদ সহপাঠী হিসেবে যাঁদেরকে পেলো তাঁরা তাঁর লেখাপড়ার প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও
বন্ধুত্ব-বন্ধনে ছিলো হৃদয়ে জড়ানো বিনে সুতোয় গাঁথা মালা।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খড়ারচর গ্রামের মোল্লা ইব্রাহীম পাঁচু (অর্থনীতিতে অনার্স,মাস্টার্স- জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়- অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী), শাহাবুদ্দিন (প্রয়াত -কৃষিবিদ, ময়মনসিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রাম-কাংশা), ছোটো মামা মোসলেম (প্রয়াত এমবিবিএস ডাক্তার, কাংশা) ও বিমান বিহারি সাহা (প্রয়াত - বিনোদপুর) প্রমুখেরা।
এঁদের মধ্যে বিমান বিহারি সাহা ছিলো নাসিরের ক্লাসের সেকেন্ড বয়। অন্যান্য সহপাঠীরাও ছিলেন তুখোড় মেধাবী। তাঁরাও নিজেদের যোগ্যতার ভূবনকে অনন্যমাত্রার উচ্চকিত আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। বিমান বিহারি সাহা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক মাইন্ডবিষ্ফোরণে মারা গেলে নাসির আহমেদ তার আকষ্মিক অভাবনীয় ও অকাল মৃত্যুতে হলেন বাকহীন বাকরুদ্ধ। বন্ধু হারাবার বেদনায় তাঁর চোখ আজও নিরব কান্নার অশ্রুসিক্ত জলে ভিজে যায় বার বার। আর স্মৃতিতে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে ওঠে বিমান বিহারির মায়াবী নিষ্কলুষ চিরচেনা মুখখানা!!
মানিকগঞ্জ জেলায় ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম হওয়ার আত্মতৃপ্তির অমোঘ আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই ১৯৬৯-এ অনুষ্ঠিত মেট্রিক পরীক্ষায় সিঙ্গাইর বাইলেটারেল হাই স্কুল থেকে সাইন্সে ৪টায় লেটারসহ ষ্টারমার্ক পেয়ে নাসির উদ্দিন আহমেদ ১ম বিভাগ পেলো।
মেধাবী ছাত্রদের চিরআরাধ্য অভয়ারণ্য দেশসেরা কলেজ ঢাকা কলেজে সে ভর্তি হলো ১৯৬৯ সালে সাইন্সের উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে। ভর্তি হয়েই সিট পেলো ঢাকা কলেজ সংলগ্ন সাউথ হোস্টেলে। হোস্টেলের কতশত স্মৃতি তাঁর মনে এখনো দোল খায়!!
ভর্তি হবার পর পরিচয়ে পরিচয়ে জানলো অসংখ্য সহপাঠীরা বোর্ডে স্ট্যান্ড করে এই ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে। তাদের সান্নিধ্য পেয়ে তাঁর মধ্যে ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিযোগিতার এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হলো। নিয়মিত পড়াশোনার কঠিন আবর্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেললো সে। তাঁর প্রতিদিনের ধ্যানজ্ঞান হলো লেখা আর পড়া।
হোস্টেল জীবন তাঁর জীবনের আরেক বাঁক, আরেক অভিজ্ঞতা।
সাউথ হোস্টেলে তাঁর ১০৮ নম্বর কক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ কামাল ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে তাঁর রুমে দু'দিন এলে তাঁর সাথে তাঁর সান্নিধ্যসাক্ষাৎ তাঁকে জীবনভর যে স্মৃতিময়তা দিয়েছে। আজও ডাক্তার নাসিরের জীবনে তা শ্রেষ্ঠ স্মৃতিসম্মান হয়ে আছে।
বন্ধু নুরুল ইসলাম (টাঙ্গাইল) আর ওবায়দুল কাদের মোঃ মোক্তাদির চৌধুরী (ব্রাহ্মণবাড়ীয়া) তখন ঢাকা কলেজ শাখার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা।
বন্ধুদের অনুপ্রেরণা ও নেতৃত্বে ঢাকা কলেজ থেকে ছাত্রলীগের যে মিছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনার জন্য রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলো সেই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন ডাক্তার নাসির।
ভাষণ শুরু হওয়ার অনেক আগে সেই মিছিলে শরিক হয়ে অত্যন্ত কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখা এবং বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণ শুনতে পারাটা ছিলো ডাক্তার নাসিরের জীবনপরিক্রমার আরেক ইতিহাস আরেক অধ্যায়। স্পর্ধিত মনে আরেক অহংকার!!
বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঐতিহাসিক এই ভাষণের প্রতিটি উচ্চারণ তাঁর মনে দেশাত্মবোধের যে বীজ উপ্ত করেছিলো, তারই মন্ত্রে সে চিকিৎসা সেবায়,মানব সেবায় দেশের আপামর মানুষের জন্য আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। এটাকেই তিনি ধর্ম মনে করেন। আর এটাকেই ডাক্তার নাসির তাঁর অহর্নিশির কর্ম বলে মনে করেন।
ঢাকা কলেজের হোস্টেল জীবনস্মৃতি তাঁর কাছে নানা বর্ণ ও রেখায় অঙ্কিত।নিউমার্কেটে ঘোরাঘুরি কিংবা বলাকায় সিনেমা দেখায় তাঁর অতৃপ্ত ছিলো না কখনো।
তাইতো ' সাধারণ মেয়ে, এতটুকু আশা,নীল আকাশের নিচে, ময়নামতি' সিনেমার নায়কনায়িকার নাম এবং তাদের অভিনয় করা নাচগানের দৃশ্যাবলীর গানগুলো পর্যন্ত তাঁর মনে এখনো দাগ কেটে আছে।
১৯৭৫ সালে আমি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় হাই স্কুল থেকে সাইন্সে প্রথম বিভাগ পেয়ে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম।জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় হাই স্কুলের আমার সহপাঠী অত্যন্ত ঘনিষ্টবন্ধু তীক্ষ্ণমেধাবী ছাত্র আমেরিকার নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির হিউম্যান সাইক্লোজির প্রফেসর এবং ডীন ড. জিয়ারত হোসেন ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে পারলেও এবং ওর সাথে আমার ঢাকা কলেজে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও সে আশা আমার পূরণ হলো না।
ফলে ঢাকা কলেজে পড়তে না পারার দুঃখবোধ থাকলেও জীবন পরম্পরায় প্রাপ্ত সাফল্য আমাকে যে ঐশ্বর্য আর ব্যক্তিভাবনার প্রোজ্জ্বলতা দিয়েছে তাতেই আমি তৃপ্ত তাতেই আমি পরিপূর্ণ।
১৯৭২ সালে ডাক্তার নাসির ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞানে ষ্টারমার্কসহ ঢাকা বোর্ডে ১৮তম স্ট্যান্ড করলে নিজের এবং অভিভাবকদের মধ্যে নাসির ভাবনা শুরু হলো।
এবারে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তির পালা। ডাক্তার, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন্ লাইনে সে পড়বে। ছোটো বেলায় আমিও এরকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছিলাম -কি বিষয়ে পড়বো। তল্লাটে বুদ্ধি দেয়ার লোক সে সময় খোঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিলো।
তবে নাসির উদ্দিন আহমেদ এদিক থেকে ব্যতিক্রম ছিলো ভাগ্যবান ছিলো। ইন্জিনিয়ারিং তাঁর প্রাইওরটি বিষয় হলেও মামা ছাবের উদ্দিন (প্রয়াত প্রিন্সিপাল, পলিটেকনিক কলেজ) বাঁধ সাধলেন। ইন্জিনিয়ারিং নয় তাঁকে ভর্তি হতে হবে ডাক্তারীতে।
শেষমেশ নাসির উদ্দিন আহমেদ ভর্তি হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে।
এলাকায় ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে শৈশব থেকেই তাঁর নামডাক শুনে শুনে আমি তাঁর ভক্ত হয়ে যাই। তাঁর ছয় বছর পর ১৯৭৫ সালে আমি মেট্রিক পাশ করলেও তাঁর মধ্যেই আমি আমাকে আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকি। কিন্ত তাঁর মেধাশক্তির ধারের কাছেও কখনো কোনদিনও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
তাঁর ডাক্তারী পাশ করার পর সময়ে অসময়ে অনেকবার তাঁর সাথে আমার দেখা হতো তাঁর সিঙ্গাইর বাইলেটারেল হাই স্কুলের সহপাঠী বন্ধু খড়ারচরের মোল্লা ইবরাহীম( অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী পাঁচু) ভাই'র বাসায়। ইবরাহীম ভাইও ছিলো অত্র এলাকার সে সময়ের তুখোর ছাত্র। নাসির আর ইব্রাহীম সহপাঠী হলেও তাঁদের বন্ধন-বন্ধুত্ব ছিলো হৃদয়উৎসরিত ফল্গুধারার মতো। ইবরাহীম ভাই খড়ারচরের ছেলে হলেও তাঁরও প্রখর মেধার দ্যুতি ছড়িয়েছিলো আশপাশের সকল লোকালয়ে। সাভারে জাহাঙ্গীর নগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে ইবরাহীম ভাই ১৯৭২ সালে ভর্তি হন অর্থনীতি বিষয়ে অনার্সে। ১৯৭৩ সালে আমি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে তাঁর আবাসিক হলে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে সে তাঁর ভালোবাসার আতিথ্যে জড়িয়ে ফেলেন। কেন্টিনে নিয়ে মিষ্টি ও অন্যান্য উপাদেয় খাবার আমাকে আর ভাগ্নে জামালকে খেতে দেন। সেদিনের সে আপ্যায়ণ আমার জীবনস্মৃতির অমর গাঁথা হয়ে এখনো আমাকে উদ্বেলিত করে। অর্থনীতিতে অনার্স- মাস্টার্স করে ইব্রাহীম ভাই চাকুরি নেন আইসিডিডিআরবি'তে। বলতে গেলে আইসিডিডিআরবি'র কম্পিউটার জগত ইব্রাহীম ভাই'র হাত ধরেই এগিয়েছিলো।
তীক্ষ্ণমেধার উপর ভর করে আর জৌলুসি জীবনভোগের মোহে ইব্রাহীম ভাই ১৯৯২ সালে দেশান্তরি হয়ে পাড়ি জমালো অষ্ট্রেলিয়ায়। চোখের আড়াল হলেও ইবরাহীম ভাই আর তাঁর পরিবারের সকলে এখনো আমার হৃদয়মনের গোপন জায়গার গোপন ভালোবাসার স্বজন।
ইব্রাহিম ভাই'র স্ত্রী মেরেজা আমার প্রতিবেশী বোন হলেও মননজগতে যেন নিজেরই আপন বোন। নাসির-ইবরাহীম ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ায় তাঁদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে কিংবা যোগাযোগে আমিও পারস্পরিক পারিবারিক বন্ধনে আটকে যাই আটকে থাকি- আর সেই সুবাদে এবং আত্মীয়তার বন্ধনে ডাক্তার নাসির উদ্দিন আহমেদকে আমি নাসির ভাই বলে ডাকি। অন্তরের বন্ধন আর নৈকট্য আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে আরো জোরালো করলে নাসির ভাই হয়ে ওঠে আমার আর পরিবারের নিকট নিত্যদিনের এক আরাধ্য মানুষ আর শ্রদ্ধায় জড়ানো এক বিরল ব্যক্তিত্ব।