ডা. জাহান সুলতানা :
বাসায় মেহমান এলে আমি খুব বিপাকে থাকি। কারন আমি মেহমানদারির ম ও জানিনা।
ধরেন মেহমানের জন্য চা নিয়ে আসা হয়েছে মেহমান চা য়ের কাপটা তোলার আগে আমি তাড়াতাড়ি নিজের চায়ের কাপটা নিশ্চিত করি! পাছে সবার নেয়া শেষে আমার জন্য কিছু বাকী না থাকে!
বাসায় মেহমান এলে আমি আসলেই খুব বিপাকে থাকি। কারন দুদিনের জন্য বাসায় বেড়াতে যাই আমি নিজেই থাকি মেহমানের মত! সবাই একটু পরপর এটা সেটা খেতে সাধাসাধি করে! নিজ বাড়িতে অতিথি টাইপ ব্যাপার। আমার আর দোষ কী!
বাসায় মেহমান এলে আমি ভয়াবহ রকমের বিপাকে থাকি! তো আমাকে মেহমানদারি শিখতে হবে যে করেই হোক!
শুনেছি মেহমান এলে খাওয়ার টেবিলে মেহমানদের সাধাসাধি করে খাওয়াতে হয়। এটা ভদ্রতা! গেরস্থ সাধাসাধি না করলে মেহমানদের খাওয়াটা অভদ্রতা। এটা কোন কথা! আমিতো কোথাও গেলে সাধার আগেই খেতে বসে যাই!
যাইহোক, মেহমানদারিটা আমাকে শিখতে হবে। আর মেহমানদারি মানে আসলে সাধাসাধি। এই সাধাসাধি করাটা নাকি একটা আর্ট! এই আর্ট আমাকে শিখতেই হবে যে করে হোক! আর্টিস্ট আমি হবোই হবো!
তো একদিন কিছু আত্মীয় স্বজন এসেছে বাসায়। ভাবি আর আম্মু রান্নাঘরে ব্যস্ত। আমার ঘাড়ে পরেছে মেহমানদরির ভার। আমিও মুখ হাসি হাসি করে মনে মনে কোমরে আঁচল বাঁধলাম। নিজেকে মহান আর্টিস্ট হিসেবে প্রমাণ করার এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায়না! সাধাসাধি কাকে বলে,কত প্রকার ও কী কী আজ আমিই দেখিয়ে ছাড়ব!
দুপুরবেলা মেহমানরা সবাই খাওয়ার টেবিলে বসেছে; পেশায় ডাক্তার হওয়ায় ভাত মাছ মাংস তরকারির বদলে আমি দেখি প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার আর ভিটামিনের সমাহার টেবিল জুড়ে।
ওমা মিনিটের মাথায় সবার প্লেটে কার্বোহাইড্রেটের কিওক্রাডং, আর প্রোটিনের বিছানাকান্দি! নাহ! এ হতে পারেনা! আমি মনে মনে চোয়াল শক্ত করলাম! এসব ঠিক না! মেহমানদেরকে ব্যালন্সড ডায়েট খাওয়াতে হবে! প্লেট ভর্তি কা্রবোহাইড্রের প্রোটিনের ভিড়ে কোন ভাইটামিন নাই! নাই কোন ফাইবার! ভাবা যায় এগ্লা!
আমি নিবেদিতপ্রাণ এক "সাধাসাধি শিল্পী" আমি থাকতে এটা হতে পারেনা! অতঃপর মেহমানদেরকে ভিটামিন খাওয়ার জন্য শিল্পিত পীড়াপীড়ি শুরু করলাম। ফাইবার আর ভিটামিনের বাটি হাতে নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করলাম এক চেয়ার থেকে আরেক চেয়ারে!
"আরেকটু ঢ়েড়স নেন!
" সবজি খান, লাল শাক দেই আরেকটু! লাল শাকে ভিটামিন এ আছে! "
"এত প্রোটিন থুক্কু মাংস খাচ্ছেন কেন? পেট কষা হবেতো! একটু ফাইবার আই মিন সবজিও নেন! পেঁপের ডালটা খান! পেট ক্লিয়ার থাকবে! "
"কী? মাছ নেবেন? একটু আগেই না এক পিস খেলেন! এখন একটু ভিটামিন আইমিন সবজি খান!"
"কী মাংস? না না আপনাকে আর মাংস দেয়া যাবেনা! কী পেয়েছেন আপনি? মাংস খেয়ে পার পেয়ে যাবেন ভেবেছেন? উহু! এতগুলো পটল কে খাবে? পটল খান!"
ভাবি এসে দেখল আমি পটলের বাটি নিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে চেয়ার থেকে চেয়ারে ছোটাছুটি করছি
" প্লিজ, আপনি নিশ্চয়ই পটল খান?"
"আপনি কি পটল খান?
" প্লিজ আপনি অন্তত পটল খান!"
"আল্লাহর দোহাই লাগে পটল খান!"
না যা ভাবছেন তা না। মেহমানদের ভেতর 'পটল খান' নামে কেউ ছিলনা।
তো ভাবি অবস্থা বেগতিক দেখে আমাকে পটলের বাটি সহ প্রায় টেনে হিঁচড়ে আড়ালে নিয়ে গেল। বলল," জাহান শোনো মেহমানদেরকে শাক সবজি সাধতে হয়না, মাছ মাংস সাধতে হয়। তুমি সবার প্লেটে এক গামলা সবজি ঢেলে দিচ্ছো! আল্লাহর ওয়াস্তে এইটা আর করিওনা। সবাই মাইন্ড করবে!"
আমি মাথা চুলকাতে লাগলাম। আমার মাথায় ঢুকলনা বিষয়টা। আমিতো আসলে সবার ইন্টেসটাইন আর স্টমাকের কথা চিন্তা করছিলাম। সবার ডায়েটটা ব্যালান্সড করার চেষ্টা করছিলাম।
মাছ মাংস অতি উপাদেয় জিনিস সন্দেহ নাই।
কিন্তু সবজির উপরেতো কিছু নাই। পেট ভাল রাখতে, হাগু নরম রাখতে সবজির কোন বিকল্প আছে? সবজিতে আছে ভাইটামিন! আর মেহমানরা নাকি বিখ্যাত সবজি "পটল" খেতে বলায় মাইন্ড করেছে! এই জগৎসংসার পটলের কদর বুঝলনা!
অতঃপর মস্তক চুলকাইতে চুলকাইতে স্বীয় ভ্রাতৃবধূ আর আম্মাজান হইতে সেদিন আতিথেয়তার কঠিন দীক্ষা লভিলাম। আবেগের আতিশয্যে ভাতৃবধূকে কহিলাম আমি তোমাদিগের অধীনে আতিথেয়তায় থুক্কু সাধাসাধিতে পিএইচডি করিতে চাই! "
এই ঘটনার বেশ কয়েকমাস পর আবার মেহমানদারির পালা এলো। মানে আমার মোক্ষম সুযোগ অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানর।
যথারীতি চা না্সতার পর্ব শেষ হতেই ডাল ভাত পর্ব।
এই ডালভাত মানেতো বুঝতেই পারছেন কমসে কম ছয় সাত আইটেম। নাহ আজকে আর ভুল করা যাবেনা। এই জগৎসংসারে পটলের কদর নাই! মাছ মাংস খেতে না বললে মেহমানরা মাইন্ড করে! আজকে আর কাউকে মাইন্ড করতে দেয়া যাবেনা! হুহ!
দুপুরবেলা মেহমানরা হাত ধুয়ে খেতে বসেছে।
আমি ছুটে এসে তাড়াতাড়ি সবার প্লেটে প্লেটে মাছের টুকরা মাংসের টুকরা তুলে দিলাম।
ওমা দেখি মেহমানরা কাচুমাচু মুখ করে ভাতের বোলের দিকে তাকিয়ে আছে।নাহ এই কার্বোহাইড্রেটের বোলটা সরাতে হবে! নাইলে অল্প মাছ মাংস খেয়েই সবার পেট ভরে যাবে! আমার মাছ মাংস সাধাসাধি সফল হবেনা!
অতঃপর আমি কার্বোহাইড্রেটের বোলটা সরিয়ে নিলাম। আর অনেক আনন্দ নিয়ে বললাম, প্লিজ আপনারা খাওয়া শুরু করেন! আরেকটু মাছ দেই! মাংস নেন আরেক পিস! মুরগীর রানের সাথে মাছের মাথা মিশিয়ে খান! অনেক টেস! "
ভাবি আর আম্মু অবস্থা বেগতিক দেখে আমার তীব্র প্রতিবাদে কান না দিয়ে ভাতের বোলটা আবার নিয়ে এলো খাওয়ার টেবিলে, আর সবার প্লেটে প্লেটে ভাত তুলে দিল—
মাছ মাংসের সমুদ্রে কয়েক পশলা ভাত!
আধ ঘন্টা পর জনৈক মেহমান গোশত চাবাতে চাবাতে ক্লান্ত হয়ে পরেছেন! অনেকক্ষন ধরেই গোশত খাচ্ছেন, ঠিক সুবিধা করতে পারছিলেন না! তার দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে মাংসের ঢেলা উঁকি দিচ্ছে!
একসময় তিনি বিরক্ত হয়ে মাংস রেখে ঢ়েডসের বাটি নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই আমি হাহা করে সেটা সরিয়ে রাখলাম। তিনি থতমত খেয়ে চোখ পিটপিট করতে করতে হাত বাড়ালেন পুঁই শাকের বাটির দিকে! আমি তৎক্ষণাৎ আঁতকে উঠে সেটাও সরিয়ে রাখলাম। এবার সেই মেহমান দাঁত কিড়মিড় করতে করতে শুটকির তরকারি খাওয়ার জন্য হাত দিলেন।
আমার মাথায় তখন ক্যালকুলেশন চলছে,
শুটকির তরকারি জিনিসটা কী আসলে মাছ-মাংসের কাতারে পড়ে নাকি সবজির কাতারে।
বাটির দিকে তাকিয়ে দেখি তাতে শুটকির পরিমান কম, বেগুনের পরিমান বেশি। আর বেগুন একটা সবজি।
আর কিছুতেই সবজির বাটিতে মেহমানদেরকে হাত দিতে দেওয়া যাবেনা।
তাই আমি ছুটে গিয়ে শুটকির বাটি সরিয়ে নিলাম
কাঁদোকাঁদো হয়ে বললাম, প্লিজ খাবেন না! এটা একটা সবজি! আমি কিছুতেই আপনাকে সবজি খেতে দিবনা! আজকে আমি মেহমানদারিতে পিএইচডি কমপ্লিট করেই ছাড়ব! "
মেহমানও হাল ছাড়লনা। বাটি নিয়ে টানাটানি শুরু করল।
ভাবি আর আম্মু বিপন্ন মুখে তাকিয়ে দেখছে এই টানাটানি। একসময় সহ্য করতে না পেরে, বাটিটার ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার আগে ভাবি আবার টেনে হিঁচড়ে আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেল
"তুমি সবজি খেতে দিচ্ছনা কেন?"
" তুমিইত বললা সবজি খেতে বললে মেহমানরা মাইন্ড করবে!"
"তাই বলে ওদের খেতে ইচ্ছে হলে তুমি খেতে দিবানা?"
আমি মাথা চুলকালাম! নোটবুক বের করে নোট নিলাম।
বড়ই কঠিন জিনিস এই মেহমানদারি!
দিনকয়েক পর ভাবি আর আম্মুর সাইন করা মেহমানদারির উপর পিএইচডি সার্টিফিকেটটা নিয়ে আমি তল্পি তল্পা গোটালাম।
এই সার্টিফিকেটে তাদেরকে সাইন করানর আগে আমাকে অবশ্য কথা দিতে হয়েছে বাসায় মেহমান এলে আমি তাদের খাওয়ার টেবিলের ধারে কাছেও থাকবনা!