সেজান মাহমুদ :
পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যখন নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও ডিগ্রী কে বিশ্বজনীন ক’রে তুলছে তখন আমরা উল্টো কাজ করছি- নিজেদের ডিগ্রী কে ডি-ভ্যালু করছি। একটা উদাহরণ দিচ্ছি-
এক। এমবিবিএস ডিগ্রী বৃটিশ কায়দায় প্রতিষ্ঠিত। তারপর মানুষজন বিলেত গিয়ে এমআরসিপি, এফআরসিএস ইত্যাদি করবে যা বৃটিশদের শিক্ষা বানিজ্যের অংশ। বাংলাদেশ তো আর বৃটিশ কলোনি না। বিশ্ব এখন আমেরিকার দিকে তাকিয়ে বা অন্যান্য উন্নত দেশের দিকে তাকিয়ে সব কাজ করে।
দুই। আমেরিকাতে এমবিবিএস ডিগ্রী ইকুইভ্যালেন্ট টু এমডি। হ্যাঁ, আপনারা অনেকেই জানেন না চার বছর প্রি-মেডিক্যাল আর চার বছর মেডিক্যাল কলেজে পড়ার পরে আমেরিকায় এমডি (ডক্টর অব মেডিসিন) ডিগ্রী দেয়া হয়। তারপর ছাত্রছাত্রীরা ইউএসএমএলই পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স করে। এই লাইসেন্সের সঙ্গে কিন্তু ডিগ্রীর কোন সম্পর্ক নেই। লক্ষ্য করুন বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস করেই বা অন্যান্য দেশ থেকে এমবিবিএস, এমবিসিএইচবি, বা ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রী করেই কিন্তু সরাসরি ইউএসএমএলই পরীক্ষা দিচ্ছে সবাই । কারণ, ECFMG (যারা বিদেশি মেডিক্যাল ডিগ্রীর মান নিয়ন্ত্রণ ও পরিমাপ করে) তারা এমবিবিএস কে “ডক্টর অব মেডিসিন” হিসাবেই ভ্যালু করে। তারমানেই হলো এমবিবিএস ডিগ্রী ইকুইভ্যালেন্ট টু এমডি। তাহলে বাংলাদেশে আরেকটি “এমডি” ডিগ্রী দিয়ে এমবিবিএস কে খামোখা খাটো করা হচ্ছে কেন?? অথচ আফগানিস্তান বা আর্মেনিয়া, ব্রাজিল, এমনকি আফ্রিকার বুরুন্ডি থেকে এমবিবিএস-এর সমান ডিগ্রী কে বলা হয় ডক্টর অব মেডিসিন বা এমডি।
তিন। এতে ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের। তারা জানছেই না যে এমবিবিএস আসলে একটি ডক্টরাল ডিগ্রীর সমকক্ষ এবং পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে বহু সুবিধা পাওয়া যায় তাতে যা অন্য দেশ শুধু নামের জন্যে পাচ্ছে। যেমন GRE WAIVER. পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশীপ পাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
চার। বাংলাদেশ থেকে মেডিক্যাল পড়ে এসে যারা আমেরিকায় লাইসেন্স করে প্র্যাকটিস করেন তারা একটা ভুল ধারনা প্রচার করেন। তা হলো, ইউএসএমএলই পরীক্ষা দিয়ে রেসিডেন্সি না করলে আপনি এমডি সমকক্ষ না। এটা চূড়ান্ত ভুল এবং আন্তর্জাতিক ডিগ্রীর মান নিনর্য়নের পরপন্থী। ইউএসএমএলই পরীক্ষা আমেরিকার এমডি ডিগ্রী নেবার পরও দিতে হয়। যেমন আমেরিকান বা অন্য কোন দেশের ডাক্তার/এমডি বাংলাদেশে গিয়ে প্র্যাকটিস করতে চাইলে লাইসেন্স করতে হয়। লাইসেন্স আর ডিগ্রী এক না।
পাঁচ। ক্লিনিক্যাল ছাড়াও যে আরো অজস্র পোস্ট গ্রাজুয়েশন জিগ্রী আছে তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা। যেমন, এমবিবিএস কে এমডি করা হ’লে তারা সরাসরি পিএইচডি করার সুযোগ পাবে, যেমন পায় জাপান বা অন্যদেশে।ডক্টরাল ডিগ্রীর মর্যাদা নিয়ে ভর্তির প্রায়োরিটি পাবে। আরো অনেক অনেক সুবিধা।
ছয় । আমেরিকা এতো বড় দেশ যে সারা আমেরিকা জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অন্যদেশ সম্পর্কে জানে না। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় তাও এখন কিছুটা জানে। তাই “ব্যাচেলর অব মেডিসিন” দেখলে তারা মনে করে প্রি-মেডিক্যাল ডিগ্রী। যা এমবিবিএস কে খাটো করছে।কারণ, আমেরিকার সিস্টেমে সাধারণত চার বছর ব্যাচেলর ডিগ্রী করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়।
আমি বিগত কুড়ি বছর ধরে সরাসরি অথবা জয়েন্ট ফ্যাকাল্টি হিসাবে কাজ করেছি আমেরিকার তিনটি মেডিক্যাল কলেজে। বর্তমান মেডিক্যাল কলেজে সহকারী ডিনের দায়িত্ব পালন ও এমডি ভর্তি কমিটিতে কাজ করেছি। এখনও এমডি কারিকুলামের অনেক দায়িত্ব পালন করি। যারা শুধু ইউএসএমএলই পরীক্ষা দিয়ে রেসিডেন্সি করেন তাঁদের অনেকেই মেডিক্যাল উচ্চশিক্ষার এই বিষয়গুলো জানেন না বা ভুল জানেন বা বলতে চান না।
তাই সহজ করে আবারো বলি- বাংলাদেশের এমবিবিএস ডিগ্রীকে এমডি বা “ডক্টর অব মেডিসিন” নাম করা উচিত। বাংলাদেশে যে তিন বা পাঁচ বছরের এমডি ডিগ্রী দেয়া হয় তা আসলে কোন পোস্ট-গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ বা স্পেশালাইজেশন হ’তে পারে। এভাবে আমাদের মেডিক্যাল শিক্ষা কে বিশ্বজনীন করার আন্দোলন করুন।
সেজান মাহমুদ
জুলাই ২৫, ২০২১
পুনশ্চ: নামকরণ হলো প্রথম ধাপ। তারপরই কারিকুলাম, মান-উন্নয়ন, ও মান-নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দিতে হবে যাতে কোয়ালিটিও বিশ্বজনীন হয়!