ডা. জয়নাল আবেদীন :
আমার ফোনে বারবার একটা নাম্বার থেকে কল আসছে। আমি ফোন ধরছি না। নাম্বারটা আমার পরিচিত, বহুল পরিচিত। একটা সময় এই নাম্বারে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছি। কয়েক শত ঘন্টা কথা ইথারে ভাসছে এখন।
সুখের কথা, দুঃখের কথা কিংবা নিতান্ত অর্থহীন কথা।
নাম্বারটা নীলার। আজকে থেকে ঠিক এক বছর আগে যার সাথে আমার প্রেম বিচ্ছেদ হয়েছে। আধুনিক সমাজের ব্রেক আপ শব্দের সাথে আমি এখনো পরিচিত নই। আমার কাছে বিচ্ছেদ শব্দটাই বেশি মানানসই, বেশি কষ্টের, বেশি অনুভূতির।
গত বছরের এই দিনে হঠাৎ করেই নীলা বলল, একটা কথা বলি?
নীলা দশ সেকেন্ড পর বলল, ইদানিং তোমাকে আর ভালো লাগছে না। সিরিয়াসলি।
আমি একটু হেসে বললাম, ভালো না লাগলে বিদেয় হও। অন্য কাউকে খুঁজে নাও।
নীলা বলল, আমি কিন্তু সিরিয়াস। তোমার প্রতি অন্ধের মতো যে টান ছিল সেটা এখন আর নেই। সব কিছু কেমন যেন পানশে মনে হয়। কি করা যায়?
আমি প্রথম বারের মতো খানিকটা চমকে গিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বললাম, টান কমে যাওয়ার কারণ?
ফোনের ওপাশ থেকে নীলা কন্ঠ নিচু করে বলল, জানি না। আমি সত্যিই জানি না। সেই আত্মছাড়া ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে এখনই কিছু একটা করা উচিত।
আমি বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, কি করতে চাও?
নীলা তারচেয়ে বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বিচ্ছেদ। আমাদের বোধহয় আর উচিত না এক রাস্তায় চলা। তোমার প্রতি আমার কোন টান নেই। তোমার সাথে থাকলে তোমাকে চিট করা হবে। আমি তোমাকে চিট করতে চাই না। এক সময় আমরা যেমন অপরিচিত ছিলাম আবার তেমন অপরিচিত আবার হয়ে যাই।
আমি বললাম, কিন্তু আমার টান তো রয়ে গেছে!
- একটু স্যাক্রিফাইস করো। সব কিছু এখনই মিটিয়ে না ফেললে কষ্ট কেবল বাড়বেই। তোমার কষ্ট, আমার কষ্ট।
আমি বললাম, প্রেমে প্রথম কে পড়েছিল? আমি না তুমি?
- সেই তুমিই আবার বিচ্ছেদ চাইছো। প্রেম তোমার, বিচ্ছেদ তোমার। আমি কেবলই একটা জড় বস্তু? আমার কোন মতামত নেই?
নীলা বলল, তুমি চাইলে আমাকে আটকিয়ে রাখতে পারবে। আমি জানি তুমি সেটা করতে যাবে না। ভালোবাসা জোর করে আনা যায় না, রাখাও যায় না। এই বিশ্বাসটা রেখো আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি না, করবও না।
আমি বললাম, তার মানে তোমার ডিসিশন ফাইনাল?
আমি কন্ঠ জোর করে ধরে বললাম, ভালো থাকতে পারবে তো?
নীলা বলল, চেষ্টা করব। তুমিও ভালো থেকো।
আমি মোটেও ভালো থাকতে পারি নি। পরের দিন সকালেই বুঝতে পারলাম আমার জীবন উলটপালট হয়ে গেছে। প্রতি দিনের গুড মর্নিং এসএমএস ফোনে আসে নি। আমি ভাবলাম হয়তো এখন আসবে কিংবা কিছু পরে।
কিন্তু আসে নি।
রাতের দিকে ফোনে কথা বলার কোন মানুষ খুঁজে পেলাম না। আমার দম বন্ধ হওয়া শুরু হয়ে গেল। সারা দিনের আটকে রাখা কথা উপচে পড়তে শুরু করল।
পরের দিন মরিয়া হয়ে ফোন করে আমি বললাম, আমার পক্ষে এভাবে সম্ভব না। এটা অন্যায় হচ্ছে।
নীলা বলল, আমার ভুল আমি স্বীকার করছি, ক্ষমা চাইছি। কোন শাস্তি দিতে চাইলে সেটাও নিতে রাজী আছি। কিন্তু আগের জায়গায় আর ফিরতে পারব না।
আমি বললাম, আমার নিরুপদ্রব জীবনে এ রকম ঝড় তোলার কি দরকার ছিল?
নীলা বলল, সেটাই তো আমার অপরাধ। তোমার থেকে চলে যাওয়াটা অপরাধ না, তোমার কাছে আসাটাই অপরাধ ছিল।
আমি বললাম, কোন ভাবেই কি সম্পর্ক রাখা যায় না? কেবল বন্ধু হয়ে হলেও?
নীলা বলল, আমরা কোন দিনই বন্ধু ছিলাম না।
নীলা নাম্বার বদলে ফেলল। তার সাথে যোগাযোগ করার আমার কোন উপায় থাকল না। আমার সব কিছু পাল্টে গেল। ভাত খেয়ে গিয়ে মনে হয় খড় চাবাচ্ছি। সব বিরস লাগে। সবাইকে অসহ্য লাগে। অভ্যাস বশত আগের মতোই রাত পার করে ভোর হয়। কিন্তু গুড মর্নিং বলার মতো কাউকে পাই না। রাতে স্বপ্ন দেখি নীলা ফিরে এসেছে। আমার হাত ধরে বলছে, আমি তোমারই ছিলাম। ভয়ের কি আছে?
প্রচন্ড সুখের আবেশ নিয়ে ঘুম থেকে জেগে যখন বুঝি সে নেই তখন বুক অসম্ভব খালি খালি লাগে।
রাতের পর রাত এ রকম বিড়ম্বনাময় স্বপ্ন দেখতে থাকলাম।
আমি ক্লাস করা বাদ দিয়ে দিলাম। আমার এক সেমিস্টার নষ্ট হয়ে গেল। ব্যাচ কো অর্ডিনেটর স্যার ডেকে পাঠালেন এক দিন।
- কি ব্যাপার জয়, ক্লাস করছো না যে? সমস্যা কি তোমার?
আমি সহজেই মিথ্যা কিছু বলতে পারতাম। রাগে ক্ষোভে কিছুই আমার গলা থেকে বের হল না। রাগ আর ক্ষোভ আমার উপর না নীলার উপর সেটা বুঝতে পারলাম না।
স্যার বললেন, লাস্ট আড়াই মাস তুমি এবসেন্ট। পড়ালেখা ভালো লাগে না? কোন কারণ ছাড়াই যদি এরকম করতে থাকো তাহলে বসো। এক কাপ চা খাও। এর মধ্যে আমি তোমার টিসি লেটারটা লিখে ফেলি।
স্যার বললেন, কাল থেকে ক্লাস করো। আর চুল দাঁড়ি কেটে অবশ্যই ভদ্রস্থ হয়ে আসবা। দেখে মনে হচ্ছে ইদানিং গাঁজা ধরেছো।
আমি পরের দুই মাসও ক্লাস করলাম না। উল্টো স্যারের কথা শোনে নতুন দুইটা আইডিয়া আমার মাথায় আসল।
গাঁজা কেনা বা টানার সাহস আমার কখনোই হওয়ার নয়। আমি জীবনে প্রথম সিগারেট ধরলাম। ধোঁয়া গলায় আটকে খুক খুক করে কাশি দিলাম। কষ্ট পেয়ে আমার ভালো লাগছে। আমার অধঃপতন আমাকে আনন্দিত করল।
আমার কাছে মনে হত সিগারেটের ফিল্টারের ভেতর নীলার হৃদপিন্ড ভরে রাখা। আগুন জ্বালিয়ে তার হৃদয় পুড়িয়ে ধোঁয়া করার মাঝে একটা পৈশাচিক আনন্দ হত তখন।
তার উপর চুল দাঁড়ি কাটা বন্ধ করে দিলাম। দেড় মাস পর আয়নায় নিজেকে বনমানুষ হিসেবে আবিষ্কার করে অন্য রকম আনন্দ হতে লাগল।
আমার কাছে মনে হতে লাগল আমি ক্লাস মিস করে, না খেয়ে, চুল দাঁড়ি রেখে সিগারেট টেনে নীলার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছি। কঠিন প্রতিশোধ। ওর জীবন ভস্ম করে দিচ্ছি।
একবার একটা ভয়ানক চিন্তা মাথায় আসলো। আমি নীলার শহরের বাসের টিকিট করে ফেললাম। ইচ্ছে হল ওর বাসার সামনে বস্তা বিছিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ব। তারপর কি হতে পারে সেটা চিন্তায় আসে নি। আমার কাছে মনে হল এটা করলেও বোধহয় নীলা কিছুটা শাস্তি পাবে।
ওকে বাস্তবে না পেয়ে কল্পনায় প্রতিদিন শাস্তি দিতে থাকলাম। ছায়া দেখে দেয়ালে ঘুষি মারা প্রতিটা কিল যে আমাকেই আঘাত করছে সেটা তখন বুঝতে পারি নি।
:
:
নীলা ৩৭ তম বার কল দিচ্ছে। আমি ফোনের উপর দিয়ে আঙুল ঘোরাচ্ছি। মস্তিষ্কের একটা অংশ বলছে ফোন ধরতে। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে বলতে, ওয়েলকাম ব্যাক নীলা। একটা বছর ধরে অপেক্ষা করছি একটা কলের জন্য।
আরেকটা অংশ বলছে, খবরদার! ফোন ধরবি না।
আমি মনের দুইটা অংশের দ্বন্ধ উপভোগ করছি। শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হয় সেটার অপেক্ষায় আছি।
আমার মনের নিষেধ করা অংশের সৃষ্টি দুই মাস আগে।
হঠাৎ করেই বাড়ি থেকে ফোন আসল মা অসুস্থ। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আমি কি অসুখ সেটা না জেনেই দৌড় দিলাম। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারলাম মা স্ট্রোক করেছেন। স্ট্রোক খুব ক্ষতি করতে পারে নি। হাত পা হালকা অবশ। ডাক্তার বলেছে ঠিক হয়ে যাবে। তবে কেয়ারে রাখতে হবে।
মা আমাকে দেখে আমি কিছু বলার আগেই বললেন, বাবা তোর এ অবস্থা কেন? চেহারার এ কি হাল! অসুস্থ নাকি?
মানুষের জীবন পাল্টে যেতে খুব বেশি কিছু লাগে না। শত বছরের হাজারটা ঝড় যে বৃক্ষ নড়াতে পারে না একটা দুই মিনিটের টর্নেডো সেই বৃক্ষ উপড়ে দিতে পারে। মায়ের সামান্য একটা কথা আমার জীবনে এলো টর্নেডো হয়ে।
বাড়ির সাথে আমার যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। দুঃখ বিলাস করতে করতে আমি মায়ের খবরই নিই নি। আজকে মা নিচ্ছেন আমার খবর। এই প্রথম নিজের কাছে নিজেকে প্রচন্ড অপরাধী মনে হলো। ইচ্ছে হল গর্তে ঢুকে পড়ি। আমি মায়ের পা চেপে ধরে বসে পড়লাম।
আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল।
পরের দুই সপ্তাহ মাকে নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ততায় দিন কাটল। নীলার কথা আমার একবারও মনে পড়ল না। নীলা স্রেফ হারিয়ে গেল। এই সময় আমার সিগারেট খাওয়ার কথা মনে পড়ল না। চুল দাঁড়ি ঠিক করে ভদ্রস্ত হয়ে গেলাম।
মাকে বাসায় রেখে যখন ফিরলাম তখন আমি নতুন মানুষ। সিগারেট আর নীলার প্রতি টান ধীরে ধীরে কমে গেল।
মাঝরাতে মাঝে মাঝে নীলা উঁকি মারে, দুপুর বেলা টানে নিকোটিন। দুই সময়ই আমি মাকে ফোন দেই। নীলা নিকোটিন হয়ে উড়ে চলে যায়। আমি স্বস্তিবোধ করি।
নীলার সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট করে দিয়েছি। ওর কুরিয়ারে পাঠানো বই দান করেছি একটা পাঠাগারে। সব এসএসএস ডিলিট করেছি। এক সময় প্রতিটা এসএমএস আমার জন্য পাথর হয়ে বুকে চেপে ধরত। ভালোবাসা মাখানো এসব কথা বাসি হয়ে পঁচে গিয়ে বিষ হয়ে যায়। আমি সব বিষ বাইরে ফেলে দিলাম।
নীলার ৩৭ তম ফোনের পর একটা মেসেজ আসল।
তাতে লেখা "পায়ে পড়ি, প্লিজ রিসিভ"।
আমি দুই মিনিট পর রিপ্লে করলাম, ভাষায় বাংলা ইংরেজীর মিশ্রণ দূষণীয় এবং বিরক্তিকর।"
নীলা রিপ্লে পেয়ে আরো তিন বার কল করল। আমি ধরলাম না। তারপর আবার মেসেজ করল। দীর্ঘ মেসেজ।
"একটা বছর আমার অনেক যন্ত্রণায় কেটেছে। প্রতি দিন ভেবেছি তুমি নিজে থেকে আমাকে চাইবে। কোথাও কোন ভুল হলো কিনা সেটা আবার বিবেচনা করবে। একটা নাম্বার বদলে ফেললে একটা মানুষ হারিয়ে যায় না। হারিয়ে যাওয়া এত সহজ না।
আমি আবার ফিরতে চাই। মাঝখানের একটা বছর জীবন থেকে বাদ দিতে চাই।"
আমি পাল্টা জবাব দিলাম।
"আমি ফেরাতে চাইনা। রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে, আলাদাই থাকুক। আমি এক বছর না, পূর্বের জীবনটাই বাদ দিয়ে দিয়েছি। দূর থেকে শুভকামনা রইল।"
আমি সিম খুলে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিলাম। চার তলার জানালা গলে সিম কার্ড কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে!
আমি মনঃচক্ষে স্পষ্ট দেখলাম সিম কার্ড নয়, নীলা উড়ে গেল।
কেন জানি মনে হল আমার বুক থেকে একটা পাথর সরে পড়ল।
আমি প্রতিদিন রুটিন করে মায়ের সাথে গল্প করি।
আমার সময় আশ্চর্য রকম ভালো কাটে। মায়ের গল্পের শেষ হয় একটা কমন কথা দিয়ে।
"বাবা তোর জন্য একটা মেয়ে দেখছি। ফুটফুটে মেয়ে। রাজী হবি তো?"
আমি হেসে হেসে বলি, একটা মেয়ে কতদিন ফুটফুটে থাকে মা? এর কি ফুটফুটানি রোগ আছে?
আমার মা হাসেন। আমার মনে হয় আমি স্বর্গের আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছি।
প্রায়ই নীলার কথা মনে পড়ে। মনে পড়লে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
নীলা আমার গল্পের নায়িকা ছিল, জীবনের নায়িকা না। গল্পের নায়িকা নিজের ইচ্ছেমত হয়, জীবনের নায়িকা ইচ্ছে মতো হয় না। বিধাতার গল্প আলাদা, বিধাতার স্ক্রিপ্ট একান্ত তাঁরই।
সেখানে নীলার নামের জায়গায় সম্ভবত অন্য কারো নাম লেখা।
আমি এখন বেশ ভালোই আছি। একবার হওয়া বসন্ত যেমন আবার না বসন্ত না হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় তেমনি একবারের বিরহ পরের জীবনের বিরহ থেকে আমাকে মুক্তি দিয়েছে।
কিছু কিছু হারিয়ে যাওয়া মঙ্গলের। হারিয়ে যাওয়া কিছু ফিরে পেতে নেই। ফিরে পেলে সাময়িক আনন্দ হয়, কিন্তু সেটার মূল্য বেশি দিন থাকে না। হারানোর ভয় প্রতিটা দিন ভর করে। তার চেয়ে একেবারে হারিয়ে ফেলাটাই মঙ্গল।
মাঝে মাঝে ভাবি নীলা কেমন আছে?
তার ভালো থাকার দায়িত্ব তার কাছে। পৃথিবীর যে কেউ যে কারো ভালো চাইতে পারে কিন্তু কেউই কাউকে ভালো রাখতে পারে না। ভালো রাখতে হয় নিজেকেই নিজে।
সুখের ব্যাপার এই নির্মম সত্য বুঝতে আমি খুব বেশি সময় নিইনি।