বছর দশেক আগের কথা। ডিগ্রী, ট্রেনিং, সব শেষ করে ডাক্তার হিসেবে লিভারপুলে থিতু হয়ে বসেছি। ততদিনে পেয়ে গেছি ব্রিটিশ পাসপোর্ট। লাল পাসপোর্ট আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে প্রায় একশ চল্লিশটি দেশে অবাধে ঢকার সবুজ সংকেত। সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে আর ভিসা প্রাপ্তির লাল বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। উড়ে বেড়াবার এই অর্জনকে উদযাপন করা দরকার। বিল,নদী, খাল, এই তিনে বরিশাল। সেই বরিশালের ছেলে আমি। ছোট বেলায় শুনেছি, বরিশালকেও প্রাচ্যের ভেনিস বলা হয়। অথচ পাশ্চাত্যের ভেনিস, লিভারপুল থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার আকাশ পথ। ভাবলাম, প্রথমেই তাহলে পাশ্চাত্যের বরিশাল থেকে ঘুরে আসি।
পানির শহর, খালের শহর, সাগর কন্যা ভেনিস। এড্রিয়াটিক সাগরের কোলে একটা বিশাল লেগুন। একশ সাতাত্তরটা খাল জুড়ে রেখেছে একশ আঠেরোটির মতো ছোট ছোট দ্বীপকে। খালের পাড়েই বাড়ি ঘর, দোকান পাট। যেখানে ইউরোপের প্রতিটি বাড়ির সামনে একাধিক নানা মডেলের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে ভেনিসে প্রতিটি বাড়ির পিছনে খালে এক বা একাধিক বাহারি মটর বোট কিংবা নৌকা বাঁধা থাকে। রাস্তার মতো সেই সব খাল দিয়েও চলে ওয়াটার ট্যাক্সি, ওয়াটার বাস। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম পানিপথ। রাস্তা বলতে সরু সরু পায় হাঁটা পথ। অবশ্য মেইন-ল্যান্ড ইটালির সাথে ভেনিসের রোড এবং রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে।
একটি বাজেট এয়ারলাইন্সে টিকেট কাটলাম। সস্তার এয়ারলাইন্স বলে শুধু একটা হ্যান্ড লাগেজ নিতে দেয়। বুকিং লাগেজের জন্য আলাদা পয়সা দিতে হয়। তখনও বাহুল্য খরচের প্রাচুর্য আসেনি জীবনে। গিন্নীকে তো চিনি, কোথাও বেড়াতে গেলে হাজারও টই টোপলা বাঁধা শুরু করে দেয়। শুনেছি, পৃথিবীতে ভেনিসই একমাত্র শহর, যেখানে এই একবিংশ শতাব্দীতেও কোনো গাড়ির চাকা ঘোরে না। নিশ্চয়ই বোঝা বওয়ার জন্য মুটেও পাওয়া যাবে না। আমাকে আর ছেলেকেই বইতে হবে। ভ্রমণের মজাটাই মাটি হয়ে যাবে। একটু চালাকি করে বললাম,
- চার দিন মাত্র থাকব। পরনের কাপড় হ্যান্ড লাগেজে নিয়ে চলো যাই। শুধু শুধু লাগেজ চার্জ দিয়ে কী লাভ?
গিন্নী আমার মিতব্যয়ী মানুষ। বাহুল্য খরচ তারও ভীষণ অপছন্দ। তবু কপাল কুঁচকে জানতে চাইল,
- সস্তার বিমানে টিকেট কাটছ, ঠিক আছে, কিন্তু সস্তার হোটেল বুকিং দিও না। নোংরা আমার একদম সহ্য হয় না।
আমি হে হে করে দাঁত কেলিয়ে বললাম,
- আরে না না। কী যে বলো? রীতিমত ফোর স্টার হোটেলে বুকিং দিয়েছি। হু হু, বুঝতেই পারছ, ইউরোপের ফোর স্টার হোটেল। একেবারে এলাহি কারবার। বাংলাদেশের সোনার গাঁ হোটেলকেও হার মানায়।
- মানালেই ভালো।
গিন্নীর গলায় বিশ্বাস এবং ভরসা, কোনোটাই তেমন দেখতে পেলাম না। একটু দমে গেলাম। মনে মনে খোদাকে বললাম, খোদা, এই বারের মতো বয়াতি বংশের ইজ্জতটা রক্ষা কইরো। তখন বুঝিনি, গান বাজনা করা বংশের পোলার ফরিয়াদ শুনতে খোদার বয়েই গেছে!
এক দুপুরে, এলাহি নাম জপ করে লিভারপুল এয়ারপোর্ট থেকে ইজি জেট এর বিমানে উঠলাম। যারা বাংলাদেশের ফকার বিমানকে নিয়ে হাসাহাসি করে, তাঁদের এই সব বিমানে একবার ওঠা উচিত। আয়তনে ফকারের চেয়ে কয়েকগুণ বড় হলেও ভেতরে আরেঞ্জমেন্ট অনেকটা একই রকম। ছোট ছোট সিট। কনজেস্টেড ওয়াক ওয়ে। বিমান বালারা নিতম্ব দুলিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মুখে, বাহুতে ঘষা দিয়ে যায়। বউকে পাশে বসিয়ে সুন্দরী ললনাদের নিতম্বের ছোঁয়া মনঃরোচক হলেও দৃষ্টিকটু দেখায়। আমি ছোট্ট শরীরটাকে আরও ছোট্ট বানিয়ে কুঁকড়ে বসে রইলাম।
ছোট ছোট সে সীটে আমাদের মতো গড়ে পাঁচ ফুটি মানুষের বসতে তেমন অসুবিধা হল না। কিন্তু বেকায়দায় পড়ল ছয় ফুটি ইউরোপিয়ানগুলা। বসতে যেয়ে হাঁটু গিয়ে ঠেকল সামনের সিটে। দেখলাম, একটু জোরে শ্বাস ফেললেও সামনের সিটে বসা যাত্রীর মাথার চুল ওড়া উড়ি শুরু করে দেয়। কথায় বলে না? সস্তার তিন অবস্থা। টিকেটের দাম কম নিলেও এরা ঘাটে ঘাটে পয়সা নেয়। বুকিং লাগেজের কথা আগেই বলেছি। বিমানে উঠে দেখি, স্ন্যাক্স খাইতে পয়সা, চা খাইতে পয়সা, পানি খাইতে পয়সা, এমনকি গান শোনার জন্য হেড ফোন চাইলেও পয়সা। মর জ্বালা, এই ব্যাটাগো ডিকশনারিতে কমপ্লিমেন্টারি বলে কি কোনো শব্দ নাই? আরে, মেহমানদারি বইলাও তো একটা কথা আছে? যা’ই চাই, মিষ্টি কইরা হাইস্যা দামডা কয়। খালি এই সুন্দরীগো বিমান বালাগো বুক কাপাইনা হাসি পাইতে কোনো পয়সা লাগল না!
আড় চোখে দেখি, গিন্নীর মুখ থমথমে। মর্নিং শোজ দা ডে। সকাল দেখে দিন বোঝা যায়। লক্ষণ ভালো নয়। আমরা বাপ বেটা চোখে চোখে এক অন্যকে সতর্ক করে দিলাম। আর মনে মনে ইষ্ট নাম জপ করতে থাকলাম। আড়াই ঘণ্টা পর “ইজি জেট” ইজিলিই আমাদের মার্কো পোলো বিমান বন্দরে নামিয়ে দিল। আর পাঁচটা ইউরোপিয়ান এয়ারপোর্টের মতই ঝকঝকে, তকতকে, সুন্দর, ছিমছাম। নো কমপ্লেইন।
এয়ারপোর্ট থেকে ভেনিস। মাইল দশেক পথ। তিন ভাবে যাওয়া যায়। ট্রেনে, গাড়িতে ও পানি পথে। ট্রেনে ও গাড়িতে একটু সস্তায় যাওয়া গেলেও পানি পথে খরচ বেশী। আর সস্তার পথ ধরতে সাহস হল না। তাছাড়া পানির শহর দেখতে এসেছি। পানি পথে যাওয়াই ভালো। ওয়াটার ট্যাক্সির টিকেট কাটলাম। নামে ওয়াটার ট্যাক্সি হলেও দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের ছোট একতলা লঞ্চের মতো। তয় টিন পিটাইয়া সোজা বানাইয়া রঙ করা লঞ্চ নয়। রীতিমত মার্সিডিজ বেঞ্জ কোম্পানির তৈরি। এত সুন্দর, যে খালি ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। মুখের উপর শেষ বিকেলের মিঠে কড়া রোদ, চোখের সামনে ভেনিস লেগুণের দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। এই লেগুণের জল গিয়ে মিশেছে এড্রিয়াটিক সাগরে। দূরে, বহুদূরে, ফোঁটায় ফোঁটায় এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভেনিস দ্বীপপুঞ্জ। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম, কেটে গেছে মেঘ, খুশির রোদে ঝলমল করছে গিন্নীর চোখ। ও যেন এক জলকন্যা। পথ ভুলে এসে পড়েছিল ডাঙ্গায়। এখন কত তাড়াতাড়ি জলে নামা যায়, তার জন্য ছটফট করছে।
ওয়াটার ট্যাক্সিতে উঠে আমি তো পুরা টাসকি খাইয়া গেলাম। এত সুন্দরও কোনো জলযান হয়? জানালার পাশে পুরু গদি মোড়া সিঙ্গেল সিট। যাতে পানি দেখতে কারো ঘাড়ের উপর দিয়ে না তাকাতে হয়। আট থেকে দশ জন বসা যায়। যথা সময়ে ওয়াটার ট্যাক্সি ছাড়ল। বিশাল এক হাঙ্গরের মতো পানি কেটে দ্রুত গতিতে ছুটল ভেনিসের দিকে। গতি আমাদের দেশের স্পীড বোটের মতো। সেই গতির তোড়ে দুপাশের পানি এতটাই উঁচু হয়ে যায় যে মাঝে মাঝে স্বচ্ছ কাঁচের জানালা পুরোটাই পানিতে ঢেকে যায়। মনে হয়, পানির উপর দিয়ে নয়, পানির ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছি আমরা। তার উপর আছে বড় বড় ঢেউ। সে ঢেউয়ে আমরা যেন পানির ভেতরেই নাগর দোলায় দুলছি। খুলনা বরিশালের পথে, স্টিমারে, লঞ্চে, কিংবা পদ্মা পার হতে গিয়ে লঞ্চে, ফেরিতে, বহুবার ঝড়ের কবলে পড়েছি। তখন ভয়ে প্রাণটা বুকে ছেড়ে গলার কাছে এসে বসে থাকত। যেন মুখ খুললেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে। এমন মধুর নিরাপদ ঝড়ে জীবনে এই প্রথম পড়লাম।
দূর থেকে ভেনিসকে দেখলে মনে হল, পানিতে ডুবে আছে শহরটা। একটু কাছে আসতে দেখলাম, ঠিক ডুবে নয়, ডুবি ডুবি করছে। রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাট, বাড়ি ঘরের ভিটা, সব পানিতে ছুঁই ছুঁই করছে। আমাদের দেশে বালি বোঝাই ট্রলার দেখলে যেমন মনে হয়, একটা ঢেউ এলে এখনই তলিয়ে যাবে, এই শহরটা দেখেও মনে হল, কোনো মতে ভেসে আছে, একটা বড়সড় ঢেউ এলেই তলিয়ে যাবে। পরে অবশ্য শুনেছিলাম, তলিয়েও যায় মাঝে মাঝে, অতি বৃষ্টি কিংবা ঝড় বাদল হলে। এই জন্য একে ভাসমান শহরও বলা হয়।
ইউরোপের প্রায় প্রতিটা শহরই দেখতে অনেকটা একই রকম। আমরা যেখানে আমাদের পুরনো ঘর বাড়ি গুড়িয়ে দিয়ে তার বুকের উপর গড়ে তুলি আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা, ওরা সেখানে ওদের সেই রেনেসাঁ যুগের স্থাপত্যকে অতি যত্নে সংরক্ষণ করে। ধরে রাখে ওদের অতীত ঐতিহ্যকে। এই শহরটা বোধহয় একটু বেশীই ধরে রেখেছে। বদল করেনি কোনো পুরনো ঘর বাড়ি। ইতিহাসবিদদের মতে, পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকে, রোমানে সাম্রাজ্যের পতনের পর, শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য, ইটালির মূল ভূমি থেকে কয়েক মাইল দূরে, ছোট ছোট এই দ্বীপগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল কিছু ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ। সেই থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে, পানির ভেতর এই শত খালের শহর।
আমাদের ওয়াটার ট্যাক্সি ঘাটে ভিড়ল। দেখি বৃষ্টি ভেজা সকালের মতই নির্মল, সতেজ দেখাচ্ছে বউটার মুখ। নিশ্চয়ই পানি দেখে দেখে পানির মতই টলোমলো আজ তার মন! পুলকিত মনে চারিদিকে তাকাই। দেখি শুধু মটর চালিত নৌযান নয়, আছে শত শত নানা সাইজের, নানা রঙের, বৈঠা বাওয়া ছোট ছোট নৌকা। দেখতে অনেকটা চিটাগাঙের সাম্পান নৌকার মত। ওরা বলে গোন্ডালা। চড়তে হবে একদিন বউকে নিয়ে।
ঘাটে নামতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এ কোথায় এলাম রে বাবা? এ যেন ঢাকার সদর ঘাট। মানুষ আর মানুষ। শুধু পার্থক্য একটাই, নেই কোনা কুলিদের ডাকাডাকি, রিকসা, ভ্যান, ঠেলা গাড়ির হাকাহাকি। নেই কোনো গাড়ির হর্ন, লঞ্চ, জাহাজের ভেঁপু, কিংবা মানুষের অকারণ চিৎকার চেঁচামেচি। কেউ আস্তে আস্তে হাঁটছে, কেউ মৃদুস্বরে কথা বলছে, কেউ ছবি তুলছে।
এই শহরে বাড়ির চাইতে হোটেল বেশী। তার মধ্য থেকে আমার সেই চার তারকা হোটেল খুঁজে বের করতে হবে। মানুষের কাছে শুনে শুনে ঠিকানা বের করতে ভালো লাগে না আমার। তাই, কোথাও যাবার আগে গুগল ম্যাপ দেখে ঠিকানাটা ভালো করে হেফজো করে নেই। প্রিন্ট আউট নিয়ে নেই। ফোর স্টার হোটেল। ভেবেছিলাম, সহজেই পেয়ে যাব। কিন্তু কোথায় সে হোটেল। এ যেন ঢাকার চক বাজার। ছোট ছোট পায় হাঁটা গলি। তার ভেতর তস্য গলি। গলির দুপাশে দোকান। বেশীর ভাগই খাবারের। আছে নানা রকম হাতে তৈরি ভেনেসিয়ান কাঁচের জিনিষ, কাপড় চোপড়ের দোকান। সে গলিতে গিজগিজ করছে মানুষ। গুগল অংকিত জায়গা দিয়েই কয়েকবার হেঁটে গেলাম। চোখে পড়ল না কোনো সুদৃশ্য গেট কিংবা অভ্যর্থনা কক্ষ। গিন্নীর মুখে বিরক্তির ভাব সুস্পষ্ট। পানি, গাছ, পাখি পছন্দ হলেও মানুষের ভিড় অপছন্দ তার। তার উপর এত মানুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে হাঁটাও তার জন্য দুষ্কর। ভাগ্যিস, শুধু হ্যান্ড ট্রলি নিয়ে এসেছিলাম। বড় লাগেজ সাথে থাকলে কুলি-হীন এই শহরে মোট বইতে বইতে আজ আমার হালিশ বেড়িয়ে যেত!
- কই তোমার ফোর স্টার হোটেল? আর কত হাঁটাবা?
গিন্নীর গলায় কড়া রোদের ঝাঁজ। সে রোদের তাপে লতার মত নেতিয়ে পড়ে মিনমিন করে বললাম,
- এই খানেই তো ছিল?
- ছিল মানে কী? হোটেল কি পাখি? একটু আগে ছিল। এখন উইড়া গেছে?
বুঝলাম না, বউ কৌতুক করছে না তিরস্কার করছে। যাই করুক, মেজাজের আগুনে পুড়ে ছাই হবার আগেই হোটেল খুঁজে বের করতে হবে। বাধ্য হয়েই এক দোকানে ঢুকে দোকানদারকে ঠিকানা লেখা কাগজটা দেখিয়ে জানতে চাইলাম, কোথায়?
ভীষণ ত্যাঁদড় আর স্বার্থপর এই ইটালিয়ান জাতি। ব্যবসা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। সে তার খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত। আমাকে তেমন পাত্তা দিল না। কয়েক বার জিজ্ঞেস করাতে আঙ্গুল তুলে আকাশের দিকে দেখিয়ে দিল। আরে ব্যাটা কয় কী? হোটেল কী আসলেই আকাশে উইড়া গ্যাছে? বরিশাইল্যা পোলা আমি। মেজাজ আমারও আছে। খালি বউর সাথে দেখাইতে পারি না, এই যা। রেগে মেগে কিছু বলতে যাব, অমনি কাঁধে কারও মৃদু চাপ অনুভব করলাম। রেগেমেগে তাকিয়ে দেখি, ছেলে মিটিমিটি হাসছে। স্বল্পভাষী এই ছেলেটা মায়ের মেজাজ থেকে আমাকে বাঁচাতে সব সময় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বললাম,
- দেখছিস? ব্যাটা কেমন আনকালচারড?
- ও আনকালচারড না বাবা। হোটেলটা এই দোকানের উপরে।
রীতিমত বেকুব বনে গেলাম। দোকানের উপরেই হোটেল, অথচ আমি দেখতে পেলাম না? এর জন্য আব্বাই দায়ী। সারা জীবন আমাকে “উফুর চৌক্কা” (উপরের দিকে তাকিয়ে যে হাঁটে) ডাকাতে আমি বোধহয় উপরের দিকে ভালো করে তাকাতে ভুলেই গেছি। বাইরে বেরুতেই ছেলে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিল, গলির মোড়ে ছোট্ট করে হোটেলের নাম লেখা। যাহ বাবা, এর চেয়ে আমাগো চক বাজারে সোলেমানিয়া বোর্ডিং এর সাইন বোর্ডও অনেক বড় করে লেখা। ভয়ে ভয়ে বউয়ের দিকে তাকালাম। না, রাগ বা তাচ্ছিল্য নয়, বরং এক ধরণের গর্ব সে চোখে। ভাবখানা, দেখো, আমার একটুখানি পোলায় যা দেখল, তুমি বুইড়া বেটা তা দেখলা না।
উপরে উঠে রিসেপসনে ঢুকতেই চোখ আমার ভুতুম পেঁচা হয়ে গেল। মুহূর্তে যেন আমরা কয়েক শতাব্দী পিছনে ফিরে গেলাম। সেই ভিক্টোরিয়ান যুগের চেয়ার, টেবিল, সোফা, লাল কার্পেটে মোড়া মেঝে। আমিও গর্বিত চোখে বউয়ের দিকে তাকিয়ে নীরবে একটু ভাব নিতে চেষ্টা করলাম, কী কইছিলাম না, একেবারে এলাহি কারবার?
চেক ইন শেষে রুমে ঢুকতেই আমার চোখের আলো ধপ করে নিভে গেল। খুবই ছোট রুম। একটা ডাবল খাট। ছোট্ট একটা গোল টেবিল। পাশে দুটো ভিক্টোরিয়ান চেয়ার। উপরে কড়ি বর্গার ছাঁদ। রুমের ভেতরে কেমন একটা পুরনো পুরনো গন্ধ। ছোট্ট জানালাটা খুলে দেখি, নীচে বয়ে চলেছে, হাজার বছরের পুরনো খাল। বুঝলাম, এই শহরে কোনো রিজেনারেশন হয় না। যেমন ছিল, তেমনই রেখে দেয় যুগের পর যুগ। ইউরোপিয়ানরা এই সব পুরনো ঐতিহ্য উপভোগ করতেই আসে। আমি কিছুটা আনমনা হয়ে গেলাম। আমিও তো খুঁজে বেড়াই আমার অতীত, আমার শেকড়, আমার ঐতিহ্য। অথচ দিন দিন আমার দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সে সব!
- এই তোমার ফোর স্টার হোটেলের নমুনা? কেমন গন্ধ! মুরগীর খোপের মত রুম। এই হোটেলে আমি থাকব না।
খাইছে আমারে। কয় কী? মাত্র একশ ষাট বর্গ মাইলের এই শহরে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ টুরিস্ট আসে। দুই তিন সপ্তাহ আগে বুকিং না দিলে হোটেলে রুম পাওয়া যায় না। এখন থাকব না বললেই হল? আমি অসহায় চোখে ছেলের দিকে তাকালাম, বাপ, আমারে রক্ষা কর।
ছেলে মাকে সামলাল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায়,
- আম্মু, এখন তো হোটেল চেঞ্জ করা যাবে না। একটু এডজাস্ট করে নাও।
আমি যেমন আমার বউয়ের কাছে ভেজা বেড়াল, বউও তেমনি তার ছেলের কাছে বিলাতি ইঁদুর। একান্ত বাধ্যগত। ছেলের কথা তার কাছে বেদ-বাক্য। বলল,
- ঠিক আছে। তবে এই বিছানায় আমি ঘুমাবো না। কে না কে শুয়ে গেছে।
- মানে কী? হোটেলে তো মানুষ ঘুমাবেই। তোমার জন্য তো নতুন হোটেল কেউ তৈরি করে রাখবে না।
এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে আমি এক হাত নিলাম।
- আমি বিছানার চাদরের কথা কইছি। কেমনে না কেমনে ধুইছে, আল্লায় জানে। তোমারে কইলাম, আমার বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার, গায়ের কাঁথা নিয়া যাই। তুমি পয়সা বাঁচাইতে আনলা না। এখনই আমার জন্য নতুন বিছানার চাদর কিনে নিয়া আসো। এই চাদরে আমি শোবো না।
মহারাণী ভিক্টোরিয়ার মতো ফরমান জারি করে দিলেন। আমরা বাপ বেটা দুজনেই জানি, তার শুচিবাই রোগ রীতিমত অসহ্য পর্যায়ের। একবার শুচি পোকা তার মাথায় ঢুকলে আর বের হয় না। এই বিছানায় তাঁকে আর ঘুম পড়ানো যাবে না। অগত্যা, বাপ বেটা বের হলাম, ভেনিস শহরে। চাদরের সন্ধানে। তাও হতে হবে খাটি সুতির চাদর। সিনথেটিক বা কৃত্রিম কিছু সহ্য হয় না তার। হোক সে চাদর কিংবা মানুষ!
ততক্ষণে রাত্রি নেমেছে ভেনিস লেগুনে। আলোয় আলোয় ঝলমল করছে ছোট্ট শহরটা। ভ্রমণ পিয়াসি মানুষগুলোর চোখে মুখেও খুশির আলো ঝিকমিক করে। আর এই আলোয় ভরা শহরে মুখ অন্ধকার করে আমি খুঁজে ফিরি বিছানার চাদরের দোকান। যুগ যুগ ধরে এডরিয়াটিক সাগরের রাণী এই ভেনিস শহর টুরিস্ট এট্ট্রাকশনের টপ লিস্টে আছে। টুরিস্টদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ভেনেসিয়ানরা সাজিয়েছে তাঁদের দোকান। তারা কেমন করে বুঝবে, এই শহরে এমন একজন টুরিস্ট আসবে, যার চাহিদায় থাকবে বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার?
রাতের ভেনিস দেখে আমার ঢাকার গুলিস্তানের কথা মনে পড়ে গেল। প্রচুর হকার রাস্তার দুপাশে। কাপড় বিছিয়ে তারা সাজিয়েছে নানা রকম খেলনা, উপহার সামগ্রী। প্রায় সবাই বাঙ্গালী এবং অবৈধ অভিবাসী। তাই পুলিশ দেখলেই তল্পি তল্পা গুটিয়ে গলির মধ্য দৌড়ে পালায়। ভেনেসিয়ান পুলিশ যে তাঁদের ধরতে পারে না, তা কিন্তু নয়। তবে দেখেও না দেখার ভান করে। শুধু মাঝে মধ্যে দাবড় দেয়। ধরলেই তো তাঁদের সরকারি মেহমান বানিয়ে হাজতে রাখতে হবে, টিকেট কেটে দেশে পাঠাতে হবে। তার চেয়ে বরং থাক না। খাক না খুঁটে খেটে।
তাঁদের একজনের সাথে কথা হল। বাড়ি মুন্সী গঞ্জ। সাত বছর হয় এসেছে। এসেছিল টুরিস্ট ভিসায়। মেয়াদ শেষে অবৈধ হয়ে গেছে। সাত বছর হয়, দেখে না বউ ছেলেমেয়ের মুখ। এই ভাবে হকারি করে মাসে মাসে দেশে টাকা পাঠায় । ওর কষ্ট দেখে আমার চাদর বিড়ম্বনা কিছুক্ষণের জন্য হালকা হল। ও’ই আমাকে জানালো, গিফট আইটেম হিসেবে সিনথেটিক বেড কভার হয়ত পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু খাটি সুতির চাদর পাওয়া যাবে না এই শহরে। ওর কথাই ঠিক। ঘণ্টা দুই ঘুরেও সুতির চাদরের দেখা পেলাম না।
ভাবলাম, অন্তত খাবার নিয়ে ঘরে ফিরি। তাতে যদি মেজাজ কিছুটা ঠাণ্ডা হয়। সেখানেও বিধি বাম। আমাদের রসনা তৃপ্ত হয় এমন কিছুই পেলাম না। ওরা বিক্রি করে পাস্তা, পিৎজা, ম্যাকারুনী, বার্গার, স্যান্ডুইচ, এই সব। কাবাব, টাবাবও পাওয়া যায়, কিন্তু হালাল নয়। পাওয়া যায় সী-ফিশ। কিন্তু তা মুখে দিলে নির্ঘাত বমি হয়ে যাবে। শুধু সেদ্ধ করে লবণ ছিটিয়ে, ভিনেগার মিশিয়ে দেয়। আমাদের মতো মশলা মিশিয়ে তেলে ভেজে দোপেয়াজা করে না। ছেলে বড় হয়েছে ইউরোপে। ওর কোনো কিছু খেতে আপত্তি নেই। তবে ও বাইরের এনিমেল প্রডাক্ট খায় না। শেষে ছেলের পছন্দের মারগারিটা পিৎজা নিয়ে হোটেলে ফিরলাম।
দেখলাম, কোনো মতে ফ্রেস হয়ে, ড্রেস চেঞ্জ করে, একটা ওড়না বিছানায় বিছিয়ে তার উপর সাবধানে বসে আছেন মহারাণী। এবারও ছেলেই মাকে সামলালো,
- আম্মু, অনেক ট্রাই করেও চাদর পেলাম না। এখন খাবার খেয়ে একটু ম্যানেজ করে নাও। কাল অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাব।
লক্ষ্মী মেয়ের মত বাপের কথার কোনো প্রতিবাদ করল না বউ। খাওয়া শেষে গুড নাইট বলে ছেলে তার রুমে চলে গেল। আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হল, কোনো রকম বড়সড় ঝড় ঝাপটা ছাড়াই আবহাওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমি একটা গানের কলি গুনগুন করতে করতে ওয়াশ রুমে ঢুকলাম। দীর্ঘ ত্রিশ বছর বিদেশে থাকলেও শরীরে এবং মনে আমি পুরাদস্তুর বাঙ্গালী। রাতে লুঙ্গী না পরলে আমার ঘুম হয় না। পৃথিবীর কোনো পোশাকেই এত আলো বাতাস খেলা করে না। রীতিমত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। গরম লাগলে হাঁটু পর্যন্ত তুলে দাও। ঠাণ্ডা লাগলে গলা পর্যন্ত টেনে দাও। তাই লুঙ্গি ছাড়া আমাই যাই না কোথাও।
ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে বউকে বললাম,
- চলো, শুয়ে পড়ি, কাল অনেক জায়গায় যেতে হবে।
- খোলো।
- কী?
- লুঙ্গী।
- এখনই?
- হ্যাঁ।
আমি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারি না। বলে কী মেয়ে? এ তো মেঘ না চাইতেই জল। মধ্য বয়সে বিনা কসরতে এমন আহবান, এ যে স্বপ্নেরও অতীত! ভাবতেই আমার মনের মধ্যেও জলের নহর বইতে শুরু করে দিল। কিন্তু এরপর যা বলল, তা শুনে সে নহর মুহূর্তে শুকিয়ে মরুভূমি। মেঘ না চাইতে জল নয়, এ তো বিনা মেঘে বজ্রপাত!
গিন্নী খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল,
- তোমার বাকি লুঙ্গীটাও বের করো। আমি একটা বিছাবো, আর একটা গায়ে দেবো। এই ম্লেচ্ছদের চাদরে আমি গা ছোঁয়াবো না।
আমি হাসব না, কাঁদব বুঝতে পারলাম না। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম,
- আর আমি?
- তার আমি কী জানি?
ব্যাস, এর পর আর কথা চলে না। ভাগ্যিস, কিশোর ছেলের জন্য আলাদা রুম বুক করেছিলাম। সেই রাতে, ভেনিসের সেই তথাকথিত চার তারকা হোটেলের কামরায়,বয়াতি বংশের ছেলের ইজ্জতের নিলাম হয়ে গেল। কেউ তা জানতে পারল না!
সময় জার্নাল/ইএইচ