ডাঃ আহমেদ জোবায়ের :
চাঁদপুর থেকে বোগদাদ বাস দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে কুমিল্লার দিকে।
জানলার পাশের সীটে মেয়েটি বসে ছিলো। পাশে তার বৃদ্ধ বাবা।
বাবার চেহারাটা মলিন। চোখগুলো অশ্রুসিক্ত।
মেয়েটি উদাস নয়নে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাসে তার চুল উড়ছে। বিয়ের পর বাবার বাড়ি ফেরা।
সাথে সারাজীবনের সঙ্গী ও ভালবাসার মানুষ হিসেবে তার স্বামীর থাকার কথা ছিলো। আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিলো।
তার বান্ধবীরা উন্মুখ হয়ে আছে তার কাছে বাসর রাতের মধুময় গল্প শুনবে বলে।
কিন্ত মেয়েটির কোন মধুর গল্প নেই। তার গল্প আজ শুন্যতায় ভরে গেছে।
মেহেদীর রঙে আঁকা আলপনাগুলো হাত থেকে মুছে যায়নি এখনো।
বিয়ের তিনদিন পর সামিয়া বাবার বাসায় ফিরছে।
মানুষটার হাত ধরে বাড়ি থেকে ৮০ কিমি দূরের অচেনা একটা বাড়িতে গিয়েছিলো সেই বাড়ি ও বাড়ির মানুষগুলোকে আপন করে নিবে বলে।
সেই বাড়িটাই তার হবার কথা ছিলো স্থায়ী বাড়ি।
সেই মানুষ ও সেই বাড়িকে পিছনে ফেলে ফিরে আসলো তার ছোট্ট জানালার সেই রুমটিতে।
বাসায় ঢুকে কারো সাথে কথা বলতে চাইলো না সামিয়া।
সামিয়ার আগমনে সবাই খুশি খুশি চেহারা নিয়ে শ্বশুরালয়ের গল্প শুনতে আসলো।
কিন্ত সামিয়া কারো সাথে কথা বলতে নারাজ।
সামিয়ার মা দরজার নক করেই যাচ্ছেন। কিন্ত সে দরজা খুললোনা সারা বিকেল।।
সন্ধ্যার একটু পর নিজ রুম থেকে বের হলো সামিয়া।
তারপর মা কে বললো,তাকে কিছু খেতে দিতে।
মা তড়িঘড়ি করে নুডুলস ও চা নিয়ে দিলেন সামিয়াকে।
সে নুডুলস খেয়ে চা খেতে খেতে তার বাবাকে বললো, বাবা কষ্ট পেওনা।
আমার এই বিয়ে টিকবেনা।
সে বলেছে, ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে।
সামিয়ার মা চিৎকার দিয়ে বললো, কি বলিস তুই এগুলো?
সামিয়া শান্তভাবে বললো, যা হতে যাচ্ছে তাই বলছি। তুমি তো পাগল হয়েছিলে বিয়ে দিতে? এখন বিয়ের স্বাদ মিটলো?
সামিয়া বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, বাবা আমার না বড় বোন আছে, না বড় ভাই আছে।
আমাদের তিন বোনকে তুমি মানুষ করার জন্য অনেক কষ্ট করে যাচ্ছো সারাজীবন।
এতগুলো টাকা খরচ করে বিয়ে দিলে।
কিন্ত তুমি একটা ভুল করেছো- তা হলো আমার রোগটা নিয়ে তাদের সাথে আগেই কথা বলা দরকার ছিলো।
আমি SLE বা সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথেমেটোসাস নামক একটা অটোইমিউন রোগে ভুগছি তা জানালে কি ক্ষতি হতো বাবা?
আমি অনেক চেয়েছি বলতে। কিন্ত তোমরা না করলে তাই বলতে পারলাম না।।
বাবা, আমি যে লুপাসের জন্য প্রেডনিসোলন ট্যাবলেট খাই।
তার সাইড ইফেক্ট হিসেবে আমার পেটে কিছু দাগ দেখা দিয়েছিলো যাকে স্ট্রায়া বলে।
লজ্জা করে লাভ নাই বাবা।
আমার পেটের সেই স্ট্রায়া দেখে আমার হাজবেন্ড সন্দেহ করছে আমার নাকি আগে বিয়ে ও বাচ্চা হয়েছে।
প্রেগন্যান্ট মহিলাদের পেটে এমন স্ট্রায়া বা স্ট্রেস মার্ক হয় যাকে স্ট্রায়া গ্রেভিডোরাম বলে।
আমি তাকে বুঝিয়ে বলেছি শান্তভাবে।
বলেছি তাকে ডাক্তারের সব কাগজ পত্র দিবো।
প্রয়োজনে সে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলেও জেনে নিতে পারে।
কিন্ত সে আমাকে স্পর্শ করেনি।
আমার চরিত্র নিয়ে তার ব্যাপক সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
সে বললো, সে নিশ্চিত আমার নাকি বাচ্চা হয়েছে।
সে আমার সাথে সংসার করবেনা।
তার আত্মসম্মান আছে, সমাজে তার সম্মান আছে।তাই সে চুপচাপ আমাকে ফিরে আসতে বললো।
বাকিটা তার অভিভাবকরা তোমার সাথে বসে ফায়সালা করবেন।
সামিয়ার বাবা অনেক দৌড়ঝাঁপ করলেন। ছেলে পক্ষের আত্মীয়দের সাথে দেখা করলেন।
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান দেখালেন।বললেন, আমার মেয়ে পবিত্র।।
পেটের এই দাগ প্রেডনিসোলন নামক মেডিসিনের সাইড ইফেক্ট। কিন্ত কেউ তা শুনতে চাইলো না।
বিয়ের ঠিক ৩০দিন এর মাথায় সামিয়া ডিভোর্স পেপার পেয়ে গেলো।
সামিয়া অনেক চুপচাপ হয়ে গেলো।
একটা বদ্ধ রুমে নিজেকে আটকে রাখতে লাগতো সারাদিন।
রোগের তীব্রতায় শরীরের ব্যাথা, মানসিক যন্ত্রনায় সে হতাশায় ডুবে গেলো।
আমার সাথে এই ফেসবুকে একদিন মেয়েটির পরিচয়।
তার সব গল্প শুনলাম।
তাকে কাউন্সেলিং করলাম।
ভুল যা করার তার মা বাবা করেছেন।
তাদের মেয়েটির রোগের ব্যাপারে আগেই ছেলেপক্ষের সাথে কথা বলে নেওয়া উচিত ছিলো।
একদিন কুমিল্লায় তাদের বাসায় গেলাম।
তার বাবার মুখ থেকেই সব শুনলাম।
তিনি তার ভুলের জন্য লজ্জিত হলেন।
মেয়েটিকে সাহস যোগালাম।
বললাম জীবন অনেক বড়, জীবন সুন্দর।
একজন আঘাত দিয়েছে বলে সবাই আঘাত দিবে এমন ভাবনাটা ভুল।
একজন অপমান করেছে বলে অন্যরা তাকে সম্মান করবেনা- এমন ভাবছে কেন সে?
ডিভোর্স হয়েছে দেখে সে পঁচে যায়নি- বললাম।
অবশ্যই একজন হৃদয়বান পুরুষ তার জীবনে আসবে।
অপেক্ষা করতে বললাম।
মেয়েটি আশা পেয়েছিলো।
এই ফেব্রুয়ারি মাসে সামিয়ার আবার বিয়ে হলো।
এবার আর কিছু লুকায়নি সামিয়ার পরিবার।
লাল বেনারশী শাড়িতে অপূর্ব লাগছিলো সামিয়াকে।
সময় জার্নাল/ইএইচ