এক.
চৈত্রমাসের ঠাডাভাঙ্গা রোদের মধ্যে হেঁটে বাড়ি ফিরছে করিমুন্নেছা ওরফে 'গুজাবুড়ি'। করিমুন্নেছাকে তার আসল নাম ধরে শেষবার কবে কে ডেকেছে সে কথা আর তার মনে নেই। খুব ছোটকালে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি আসার পরে মুরুব্বিরা সবাই তাকে 'বউ' বলেই ডাকত। শুধু তার স্বামী আড়ালে আবডালে আদর করে তাকে 'নেছা' বলে ডাকত। পরে তার একমাত্র ছেলে মনিরের জন্ম হলে সবাই ডাকত মনিরের মা বলে। এখন বয়সের ভারে লাঠিতে ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটে বলে সবাই তাকে 'গুজাবুড়ি' বলে ডাকে।
করিমুন্নেছা মাইল খানেক দূরের মুন্সিবাড়ি গিয়েছিল জয়নাল মুন্সির চল্লিশা খেতে। বেশ কিছুদিন ধরেই লোকজন বলাবলি করছিল এই চল্লিশায় বুটের ডাল দিয়ে গরুর মাংস রান্না করা হবে। ঝাল ঝাল করে রান্না করা এই মাংসের স্বাদই আলাদা, অনেক রান্না একসঙ্গে হয় বলে মজাটা যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। করিমুন্নেছার খুব শখ হয়েছে চল্লিশা খেতে যাওয়ার। সে সবাইকে বলে রেখেছে, "তোরা যাওয়ার সময় আমারে লইয়া যাইস, কতদিন জোমাত খাই না"! আশপাশের বউ ঝিরা চল্লিশা খেতে যাওয়ার সময় তাকে ডেকে নিয়ে যায়।
মাটিতে বসে মাটির সানকিতে করিমুন্নেছা অনেক মজা করে খায়, খেতে খেতে একটু যেন বেশিই খাওয়া হয়ে যায়। শেষে একটা কুরকুরে হাড্ডি পেয়ে বুড়ির চোখদুটো চকচক করে উঠে। মনে পড়ে জোয়ান বয়সের কথা, সে হাড় খেতে পছন্দ করত বলে তার স্বামী সব সময় এমন কুরকুরে হাড় ওর পাতে তুলে দিত। তখন দাঁত ছিল, হাড় চিবিয়ে ধুলার মত গুড়া করে খেয়ে ফেলত। এখন দাঁতহীন মাড়ি দিয়ে হাড়টা খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। বুড়ির সঙ্গে আসা লোকজনের খাওয়া শেষ, তারা হাত ধুয়ে এসে বলে, "দাদি চলেন বাড়ি যাই"।
-তোরা আউগা, আমি আইতে আছি।
সাবাই চলে যায়। হাড় চুষতে চুষতে বুড়ির ঘুম পেয়ে যায়। একজন এসে বলে "চাচি, আর এক ব্যাচের লোক খাইতে বসবে। এখন ওঠেন"। করিমুন্নেছা লজ্জিত হয়ে উঠতে চেষ্টা করে, কিন্তু পায়ে ঝি ঝি ধরে গেছে উঠতে পারে না। ছেলেটা হাত ধরে তুলে লাঠিটা হাতে ধরিয়ে দেয়। করিমুন্নেছা ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়ির পথ ধরে। মাঝ রাস্তায় আসার পরে করিমুন্নেছা একবার আকাশের দিকে তাকায়। সূর্য যেন আগুণের গোলা ছুঁড়ে মারছে, চোখ যেন ঝলসে গেলো। চারিদিকে তাকিয়ে করিমুন্নেছা দেখে একটা মানুষ তো দূরের কথা, কোথাও একটা গোরু বা ছাগলও বাঁধা নেই। রাস্তার দুই দিকে শুধু ফেটে চৌচির হওয়া ফসলের মাঠ। করিমুন্নেছার খুব হাঁসফাঁস লাগে, একবার মনে হয় মুন্সিবাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু তাকিয়ে দেখে যে সে ঠিক মাঝ রাস্তায় চলে এসেছে। সামনে খন্দকার বাড়ির পরে হাওলাদার বাড়ি, তার পরেই তার ঘর।
হাঁটতে হাঁটতে হাওলাদারদের নতুন বউ রোমেলার কথা ভেবে মনে শান্তি পায়। বউটা তাকে বড় ভালোবাসে। বাচ্চা হবে বলে বাপের বাড়ি গেছে অনেকদিন। ওর ছেলে হয়েছে বলে খবর এসেছে, খুব শীঘ্রই চলে আসবে। বউটার মনে অনেক দয়া, বউটাকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করে। করিমুন্নেছা তার শরীরের সমস্ত শক্তি আর মনের জোর এক করে হেঁটে চলে।
দুই.
বাচ্চা কোলে রোমেলা তার স্বামীর সাথে বাড়ি ফেরে দুপুরের দিকে। ওর শাশুড়ি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দোয়া পরে ফুঁ দিয়ে দেয়। এই ফাঁকে রোমেলা শাশুড়িকে ছালাম করে উঠতে উঠতে জানতে চায়, "আম্মা পাশের বাড়ির দাদি কেমন আছে"?
- ভালোই আছে, আইজ আবার জোমাত খাইতে গেছে মুন্সি বাড়ি।
রোমেলা সেই ছেলেবেলা থেকেই ওর দাদির সঙ্গে ঘুমাত। দাদি কতো যে গল্প করত ওকে জড়িয়ে ধরে। মা কোন কারণে বকা দিলে বা মারলে দাদিই প্রশ্রয় দিত। ও যখন দশম শ্রেণীতে পড়ে তখন একদিন স্কুলে জরুরী খবর গেলো। বাড়ি এসে দেখে দাদি আর বেঁচে নেই। হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেছে। দাদি মারা যাওয়াতে রোমেলা আকুল হয়ে কেঁদেছিল। ওর খুব মরে যেতে ইচ্ছা হতো, মনে হতো দাদি বেঁচে না থাকলে ওর বেঁচে থেকে কি লাভ ! ও অনেকদিন ওর দাদির খুটখুট করে পান ছেঁচার শব্দ, শ্বাসে-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেত। এমনকি দাদির গায়ের ঘ্রাণ, তার মাথায় মাখা ত্রিফলা তেলের ঘ্রাণও পেতো। মাঝে মাঝে ও দাদিকে দেখতেও পেতো। সেই সময় ওর মা অনেকদিন ওর সঙ্গে এসে ঘুমাত। আস্তে আস্তে ও স্বাভাবিক হয়। এইচএসসি পাশ করার পরে এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে চলে আসে। বিয়ের সময় বাবার কাছে একটাই আবদার করে, "আব্বা দাদির পালঙ্কটা আমি নিয়া যাবো"।
- কেন রে মা! পুরানো পালঙ্ক নিলে তোর শ্বশুর বাড়িতে নিন্দা হবে, আমি ভালো কাঠ দিয়ে নতুন বক্স খাট বানায়া দেই।
- না আব্বা, আমি দাদির স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে এই খাট নিতে চাই। দাদি এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পরে তার শ্বশুর তারে এই খাট বানায়ে দিছিলো। এই খাটে শুয়ে দাদি সারা জীবন পার করছে, আমিও এই খাটে শুয়ে আমার জীবন পার করতে চাই। তুমি আমার শ্বশুরবাড়ির লোকদেরকে বলবা যে এটা আমার শখ, তাইলে তারা কিছু মনে করবে না।
একদিন করিমুন্নেসা পাশের বাড়িতে বউ দেখতে এসে মাটিতে বসে বউয়ের হাতের চুড়ি, কানের দুল, গলার হার সব নেড়েচেড়ে দেখে আর বলে, "বউ, তোমার বাপের বাড়ি থাইকা এসব দিছে"? বুড়ির স্পর্শে বউয়ের শরীর কেমন করে ওঠে, অনেকদিন আগের স্পর্শের কথা মনে পড়ে যায়। বউ ভালো করে বুড়ির দিকে তাকায়, মনে হয় ওর মৃত দাদি-ই কোনভাবে এখানে চলে এসেছে।
বউ লাজুক হেসে বলে, "জি দাদি, আমার আব্বা শখ কইরা দিছে। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকে কিন্তু চায় নাই। আপনে মাটিতে বইসা আছেন কেন? খাটে উইঠা বসেন"।
বলে হাত ধরে করিমুন্নেছাকে খাটে টেনে এনে বসায়। অনেকক্ষণ ধরে এটা ওটা গল্প করে। বিষয়টা বউয়ের শাশুড়ির পছন্দ না হলেও নতুন বউকে কিছু বলে না, কারণ বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে দেয়া পালঙ্কেই বউ করিমুন্নেছাকে বসিয়েছে।
বুড়ির তিনকুলে কেউ নেই, আশপাশের বাড়িতে ভিক্ষা করে খায়। বেশি দূরে ভিক্ষা করতে যেতে পারে না, শরীরে কুলায় না। আবার এক বাড়িতে ঘন ঘন গেলেও লোকে বিরক্ত হয়।
রোমেলার রান্না ঘরের পাশেই বুড়ির ছিন্ন কুটির। রোমেলার রান্না শেষ হলেই কলাপাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে ফিসফিস করে ডাকে, "দাদি, ও দাদি একটু মাছ রান্না করছি, নেন"। করিমুন্নেছা ফোকলা দাঁতে হেসে মাছের বাটি নিয়ে নেয়। রোমেলা প্রথমদিকে শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে দিত। পরে শাশুড়ি বিরক্ত হয় দেখে নিজে না খেয়ে, সেইটাই শাশুড়িকে লুকিয়ে করিমুন্নেছাকে দিত। শাশুড়ি টের পেয়ে ভাবে, "আহা মেয়েটার দয়ার শরীর, শেষ বয়সে আমাকেও এই মেয়ে আদর যত্নে রাখবে"।
একদিন রোমেলা কৈ মাছ রান্না করবে। শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে, "আম্মা, কৈ মাছ কয়টা রান্না করব?'
- আমাদের সবার জন্য একটা কইরা নেও, আর তোমার দাদির জন্য একটা নিও। না হলে তো নিজে না খাইয়া দিয়া দিবা, এমন করলে তোমার শরীর টিকবে?
শাশুড়ির সহানুভূতি আছে দেখে এখন রোমেলা অনেক সময়ই করিমুন্নেছাকে খাওয়া দিতে পারে নিঃসঙ্কোচে। ও মনে মনে শাশুড়ির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়।
রোমেলা একদিন বলল, "দাদি আপনার চুলগুলো কেমন শুকনা হয়ে আছে। আসেন তেল দিয়ে দেই"। রোমেলা করিমুন্নেছার চুলে তেল দিয়ে আঁচড়ে যত্ন করে একটা বেণী করে দিয়ে, আয়না সামনে ধরে বলে, "দেখেন দাদি আপনাকে নায়িকা শাবনুরের মত লাগে"।
শুনে বউয়ের শাশুড়ি জোরে জোরে শব্দ করে হাসে। করিমুন্নেছা বলে, "হে কেডা? হের ও কি মোর লাহান দাঁত নাই, চুল পাহা আর চামড়া কুঁচকাইয়া গ্যাছে"?
এবার রোমেলাও ওর শাশুড়ির মতো জোরে শব্দ করে হাসে।
রোমেলা করিমুন্নেছাকে একটা শিশিতে বেশ খানিকটা নারিকেল তেল দিয়ে দিলো পরে মাখার জন্য। রোমেলা খেয়াল করে করিমুন্নেছা পান মুখে দিয়ে অনেক কষ্ট আর কসরত করে মাড়ি দিয়ে চিবিয়ে পান খায়।
রোমেলা বাবার বাড়ি বেড়াতে গেলে করিমুন্নেছার জন্য দুইটা শাড়ি, একটা ত্রিফলা তেলের বোতল আর ওর দাদির পান ছেচুনিটা এনে দিলো। করিমুন্নেছা মনে মনে রোমেলার জন্য আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে।
করিমুন্নেছার বড় কষ্টের জীবন। জওয়ান বয়সে স্বামী মারা গেলে মানুষের বাড়ি কাজ করে ছেলে বড় করল, বড় আশায় বুক বেঁধে। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে নাতি নাতনীর মুখ দেখবে স্বপ্ন দেখে করিমুন্নেছা। কিন্তু না, সে স্বপ্ন তার পূরণ হয় না, তার একমাত্র ছেলে মনির মাত্র বাইশ বছর বয়সে সাপের কামড়ে মারা যায়। সেই থেকে করিমুন্নেছা একা থাকে। মানুষের একটু মায়া, একটু ভালবাসা, একটু স্নেহের পরশ থেকে সে বহুদিন বঞ্চিত।
রোমেলার কথে ভাবতে ভাবতে করিমুন্নেছার চোখ দিয়ে জ্ল গড়ায়। সেই জল আনন্দাশ্রু, সে সেই জল মোছার কোন চেষ্টা করে না। সে আরো দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করে।
তিন.
খন্দকার বাড়ি থেকে আলাল এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, "চাচি, আপনেগো বাড়ির পাশের বাড়ির গুজাবুড়ি আমাগো বাড়ির বারান্দায় আইসা ফিট পড়ছে, মনে অয় মইরাই যাইবে"।
শুনে রোমেলা বলল, "আম্মা, আপনে বাচ্চা দেখেন আমি গেলাম"।
শ্বশুড়ি কিছু বলার আগেই বউ মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিয়ে আলালের সঙ্গে চলে এলো খন্দকার বাড়িতে। এসে দেখে একটা ঘরের খোলা বারাব্দায় অনেক ভিড়। রোমেনা দৌড়ে গিয়ে সবাইকে বলল, "সামনে থেকে ভিড় কমান, বাতাস আসতে দেন"। ও গিয়ে মাটিতে বসে পড়ে করিমুন্নেছার মাথাটা কোলে তুলে নিলো। একজনের হাত থেকে পাখা টেনে নিয়ে বাতাস করতে করতে বলে, "ও দাদি, চোখ মেলেন, কথা বলেন। আমি চইলা আসছি"।
রোমেলা কাঁদতেই থাকে। কান্না সংক্রামক, ওর কান্না দেখে উপস্থিত অন্য মহিলারাও কাঁদতে থাকে। কে যেন একজন বলল, "ও আলাল, কবিরাজরে খবর দে"।
এর মাঝে রোমেলার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল করিমুন্নেছার কপাল, গাল আর চোখে।
এতক্ষণ এতো লোক কত যে পানি ছিটাল, তাতে তার কিছুই হয়নি। যেন সে কোন প্রিয়জনের দুফোঁটা চোখের জলের-ই অপেক্ষা করছিল। করিমুন্নেছা এবার আস্তে আস্তে চোখ খুলে প্রথমে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। পরক্ষনেই ঠিক মাথার উপরে রোমেলার মুখ দেখে বলল, "ও বউ, তুমি আইছ"?
করিমুন্নেছার চোখে মুখে ফুঁটে উঠলো এক স্বর্গীয় ভুবন ভোলানো হাসি।
কুঁচকানো চামড়ার ফোকলা মুখের হাসিও যে এতো সুন্দর হতে পারে তা ওখানে উপস্থিত লোকজন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতো না!
লেখক :
জেসমিন আরা বেগম, আমেরিকা প্রবাসী,
প্রাক্তন উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, (বিপিএটিসি)।