সর্বশেষ সংবাদ
জেসমিন আরা বেগম:
আমাদের বাড়ির রইশ্যা দুদু (গ্রামের রইশ্যা দুদু, শহরের মধ্যবিত্তের রশিদ চাচা আর উচ্চবিত্তের রাশেদ আঙ্কেল) ঢাকা শহরে রিক্সা চালায়। তার পুরা নাম রশিদ হাওলাদার, আমার জ্ঞাতি চাচা। আমাদের ঘর থেকে কোনাকুনি ভাবে তাদের ঘরের অবস্থান। আমাদের ঘর দক্ষিণমুখী আর ওদের ঘর পূর্বমুখী।
গ্রামের সাধারণ কৃষক ঘরের ছেলে কি করে ঢাকা শহরের রিকশাওয়ালা হলো? এসব ক্ষেত্রে নদী ভাঙ্গনই আসল কারণ। কিন্তু আমাদের বাড়ি থেকে পায়রা নদী মাইল দেড়েক পশ্চিমে, তাই আমাদের বাড়ির কেউ নদী ভেঙ্গে সব খুঁইয়েছে এমনটা দেখিনি বা শুনিনি।
রইশ্যা দুদুর বাবা আশেদ দাদু একটু আলসে প্রকৃতির আর ভোজন বিলাসী মানুষ। সাধারণত গ্রামের বাড়িতে লোকে ঘরের আশেপাশে, পুকুর পাড়ে, বা এক টুকরা জমিতে শাক সবজি যেমন শীম, লাউ, কুমড়া, বেগুণ, লাল শাক, পালং শাক ইত্যাদি চাষ করে থাকে। আর কচু শাক, শাপলা, কলমি শাক, হেলেঞ্চা শাক, আঘ্রা শাক, ঢেঁকি শাক-এসব তো আশেপাশের জঙ্গল থেকে কুড়িয়েই আনা যায়। বাজার থেকে চাল, ডাল, কেরোসিন তেল, আলু আর লবন কিনলেই চলে। কিন্তু আশেদ দাদু অনেক সৌখিন, খাওয়া দাওয়ার ডাটফাট ভালোই আছে। বয়স হওয়ার কারনে তেমন খাটতে পারেন না, জমি বিক্রি করে খান।বাজার থেকে লাউ, কাঁকরোল, ঝিঙ্গা, করলা ইত্যাদি কিনে আনতে দেখলে তাঁর বউ তাকে বকাঝকা করেন। গ্রামের লোকের কাছে অমিতব্যয়িতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ালেন আমাদের আশেদ দাদু। কেউ অপ্রয়োজনীয় খরচ করলে লোকে তাকে 'আশেইদ্দা' বলে ডাকতে শুরু করল।
বসতবাড়িটুকু ছাড়া সব বিক্রি হয়ে গেলে রইশ্যা দুদু তরুণ বয়সেই ঢাকা শহরে গিয়ে রিকসা চালাতে শুরু করে। সেই সময় তাকে ভুইলা যাওয়ার মত গ্রামে কোন সখিনা ছিল কি না তা আমরা ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা প্রচুর গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়েও বের করতে পারিনি।
রইশ্যা দুদুর বিষয়টা অনেকটা সেই গানের মত হলো, "এক পুরুষে করে ধন, এক পুরুষে খায় । আর এক পুরুষ এসে দেখে খাওয়ার কিছু নাই । আমার তিন পুরুষ, তিন পুরুষ আমার তিন পুরুষ ।"
রইশ্যা দুদু মাঝে মাঝে বাড়ি আসলে আমরা আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখি। তখন আমাদের সব আকর্ষণ ওদের ঘরের দিকে তীব্র বেগে ধাবিত হয়। সারাদিন ওদের উঠানে বা ঘরে গিয়ে পড়ে থাকি। পেটে ক্ষুধা লাগলে বা মা ডাকতে পাঠালে অতি কষ্টে ঘরে ফিরি।
এইভাবে আসা যাওয়া করতে করতে রইশ্যা দুদু একবার বাড়ি আসল চুলে জটা আর মুখ ভর্তি দাড়ি নিয়ে। আমি এর আগে বা পরে বাস্তবে জটাধারী কাউকে দেখিনি। জটা নিয়ে আমাদের আগ্রহের সীমা নেই। বড়রা বলে, "এটার মাঝে বুজরুকি আছে"। কেউ বলে, "কাইটা ফালা"। আবার একজন বলে," না না, জটা কাডলে রক্ত পড়তে পড়তে ও মইররা যাইবে"। সবাই বলে জটা এমনিতেই হয়েছে, এর মাঝে মারফতি ব্যাপার সাপার আছে। আমার কেন যেন মনে হল দীর্ঘদিন চুল না আঁচড়াতে আঁচড়াতে জটা হয়েছে।
বছরখানেক পরে রইশ্যা দুদু বাড়ি এলো সঙ্গে করে এক লাল টুকটুকে বউ নিয়ে। জটা, দাড়ি সব উধাও। বউয়ের নাম পরীবানু, বাড়ি অন্য কোন জেলায়। কিন্তু পরিবার ঢাকায় থাকে বলে কথাবার্তায় ঢাকাইয়া টান। আমাদের থেকে আলাদা বলে আমদের কাছে শুনতে ভালো লাগে। এবার আমরা নাওয়া খাওয়া ভুলে রইশ্যা দুদুদের ঘরে পড়ে থাকি। বউ কথা বলে কম, মৃদুস্বরে-প্রায় শোনা যায় না। আমরা কান পেতে অতি কষ্টে তাই শুনি, বাকি সময় বসে বসে বঊ দেখি। দুপুর বেলায় বউয়ের ননাস জোহরা ফুপু বলে, "তোরা যা, বউ এহন নাইবে"।
আমরা ভাবি, "আমাদের সামনে গোসল করলে কি অসুবিধা! বউ শাড়ি বদলানোর সময় আমরা চোখ বুজে থাকলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়"।
না, সাহস করে মনের ভাব প্রকাশ করি না। জোহরা ফুপু অনেক মুখরা, শেষে আমাদের পুরা গাংকেই নিষিদ্ধ করে দিতে পারে।
আমরা মুখ গোমড়া করে চলে আসি। ভাত খেয়ে আবার যাই, আমাদের বঊ দেখাই আর শেষ হয় না।
একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি উঠানে অনেক হইচই। ঘর থেক উঠানে নেমে এলাম, হালকা শীত লাগছে। কাছে গিয়ে দেখি পরী চাচি তাদের ঘরের কাছেই একটা বাঁশঝাড়ের মাথায় বসে আছে। শাড়ি পড়া, মাথায় কাপড়ও দেয়া। পাশের আম গাছ বেয়ে উঠে অনেক কসরত করে কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে বাঁশ ঝাড়ের উপর থেকে তাকে নামাল। পরীচাচির হুশ নেই, তার মুখে পানির ঝাপটা দেয়া হচ্ছে।
নারীপুরুষ সবাই এই ঘটনার নানান ব্যাখ্যা দিতে লাগলো। কেউ বলে, "দিসটি আইচে"-মানে ভুতে আছর করেছে। কেউ বলে জীনের আছর। পরে যথারীতি ফকির (ওঝা) ডেকে জীন ছাড়ানো হলো। সেই পর্ব অনেক করুণ!
রাতের বেলা শাড়ি পরা একজন নারী কি করে বাঁশ ঝাড়ের মাথায় গেলো সে আজো এক রহস্য।
এই ঘটনার চল্লিশ বছর পরে পরী চাচির সাথে আমার দেখা হলো আমার বোনের বাসায়। আমি ভাবলাম, ওই রহস্যটার সমাধান এবার চাচির কাছ থেকে বের করে নিব। কিন্তু হায়, মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।
চাচির সাথে গল্প করে জানলাম, রইশ্যা দুদু মারা গেছে অনেক আগেই। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে সংসারী। অভাব নিত্যসঙ্গী। আমি চাচিকে জিজ্ঞেস করলাম, "চাচি আপনি যে একবার বাড়িতে গিয়ে বাঁশঝাড়ের উপরে উঠে বসেছিলেন, আপনার মনে আছে"? আমি পাকা গোয়েন্দার মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছি চাচির মুখে। আমি ভাবছি কম বয়সে ঘটা সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে চাচি লজ্জা পাবে বা ভয় পাবে। কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে সেই মুখে কোন ভাবই ফুটে উঠল না, পুরাপুরি নির্লিপ্ত সেই মুখ। চাচি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, " না"। তার কথা আমি বিশ্বাস করেছি।
Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.
উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ
কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল