বুধবার, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২১
বয়েস তখন কাঁচা। 'এইম', 'লাইফ'- এসব শব্দের তাৎপর্য বোঝার চেয়ে মুখস্থ করা ঢের সোজা। সারা বিকেল টো টো করে ঘুরে সন্ধ্যায় হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসি। ক্লান্ত চোখ যতক্ষণ না ঘুমে জড়িয়ে আসে ততক্ষণ গুনগুন করতে থাকি- My aim in life is to be a doctor. I would like to be a doctor to serve the poor people of my village....
এতটুকু পড়তে পড়তেই বইয়ে মুখ গুজে ঘুমিয়ে পড়ি। মশার কামড় খেতে খেতে স্বপ্ন দেখি, "বাড়ির সামনে ছোট্ট মাঠ- টেবিলের এপারে আমি আর ওপারে সারি বেধে দাড়িয়ে থাকা অসংখ্য অসহায় "ভিলেজ পিপল"। পরদিন আবারও 'aim in life..', মশার কামড় আর ফ্রিতে বায়োস্কোপের বদলে আবারও সেই স্বপ্ন দেখা..
এ চক্রে দিন বদলায়, ক্যালেন্ডার বদলায়, প্রতি বছর নতুন ক্লাসের হাজিরা খাতায় নাম ওঠে, মুখের চারপাশে দাড়ি-গোফের আভাসে হাসিটা লাজুক হয়ে ওঠে; কিন্তু, 'aim in life..' বদলায় না, 'ভিলেজ পিপল' এর আশেপাশেই ঘুরতে থাকে। পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনী জনসভায় সব দলের একই বক্তৃতা শুনি আর প্রতি ক্লাসে একই 'এইম' লিখে পাশ করে যাই।
দশ বছরের এই প্যারাগ্রাফ আর রচনার জ্ঞানসমৃদ্ধ হয়ে মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার আগেই আমাদের ধারণা জন্মে যায়, ডাক্তার শুধু গ্রামের দরিদ্র মানুষদেরই দরকার পড়ে, শহরে এই শব্দটি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।
উল্টোদিকে, একই প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করা নন-মেডিকেল মানুষদেরও চিন্তা হয়ে ওঠে, "ডাক্তারি কোন পেশা নয়, এটি একটি মহৎ সেবামূলক কর্মকাণ্ড" (ডাক্তারদের মুখের ভাত সম্ভবত সরাসরি আসমান থেকে নাযিল হয়)।
তাই সদ্য কৈশোর পেরোনো কেউ যেদিন হাজারো নির্ঘুম রাতের গল্প শেষে মেডিকেলে চান্স পায়, সেদিন তার নাম শুধু মেডিকেল কলেজের হাজিরা বইতেই লেখা হয় না, নিজের অজান্তেই সে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ চ্যারিটি ক্লাবের সদস্যপদেও নাম লিখিয়ে ফেলে।
তার ক্লাস-পরীক্ষা যাই থাকুক না কেন, আত্নীয়-প্রতিবেশী-বন্ধু সকলের চিকিৎসার ভার তাকেই বহন করতে হয়।
ইতোমধ্যে, পাঁচ বছর কেটে গেছে। অন্যেরা যখন জীবনকে একটু একটু করে সমাজের সাথে জুড়তে থাকলো, আমরা তখন সমাজ থেকে একটু একটু বিচ্ছিন্ন হওয়া শুরু করলাম। ব্যাস্ততম পাঠ্যসূচি, শিক্ষকদের ক্রমাগত অবন্ধু-সুলভ আচরণ আর 'বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছাসেবা'র চাপ সমাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে আমাদেরকে শূন্যে দাড় করিয়ে দিলো।
আমরাও বিভক্ত হয়ে গেলাম- একপক্ষ মেরুদণ্ড বিলীন করে দিয়ে শুয়োপোকা হয়ে বাঁচতে শিখলো, অন্যপক্ষ বৃথাই সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগা শুরু করলো, " আমাদের উপরে কেউ নাই, নিচে কেউ নাই, ডাইনে কেউ নাই, বামে কেউ নাই"।
এ দুইয়ের ভিড়ে পড়ে মাঝের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ- যারা হাসিমুখে "বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছাসেবা"কেই নিজেদের জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছে, তারা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে গেলো।
এবারে দৃশ্যপটে হাজির হলো রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্র এই "বোকাসোকা " মানুষগুলোকে ভিত্তি করে গড়ে তুললো রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা। ভিত্তিতে এরা থাকলে কি হবে, দৃশ্যমান জায়গাগুলো সবই দখল করে নিলো প্রথম দুই পক্ষ- মেরুদন্ডহীন শুয়োপোকা নয়তো সুপিরিয়র ফ্যান্টাসিতে ভোগা স্বার্থান্বেষী অংশ ।
ক্ষতিটা হল কী?
শুয়োপোকা আর স্বার্থান্বেষীদের গালি দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে ফেললো ঐ "রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক" দের।
শুয়োপোকারা গর্তে পালালো, স্বার্থান্বেষীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলো।
মুখোমুখি-এপারে সাধারণ জনতা -যারা রাষ্ট্রের কাছে সেবার অধিকার দাবি করে, ওপারে, সাধারন চিকিৎসক যারা মানুষের অধিকারকে নিজেদের কর্তব্য বলে হাসিমুখে পালন করে।
আর রাষ্ট্র? সেতো মুখোমুখি দাড় করিয়েই খালাস।
দিনশেষে তাই, "প্রফেশনাল চিকিৎসক" শব্দটা আমাদের কাছে শুধু ঋণাত্নক অর্থই বোঝায়, "চিকিৎসক" শব্দটাও কোন পেশাজীবির পরিচায়ক নয়, এটি একটি "বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছাসেবা"।
________________________________
লিখেছেন - ডা: আহমাদুল্লাহ, এমবিবিএস (ডিএমসি)