ড. আশির আহমেদ:
আক্কেল দাঁত এর সমস্যা নিয়ে জাপানি ডাক্তারের কাছে গেলাম। উনি বিস্তারিত না দেখেই এক্সরে করতে নির্দেশ দিলেন।
এক্সরে কেন? আমার দাঁতের কি কোন হাড্ডি আছে যে ভাঙতে বা মচকাতে পারে?
তিন মিনিটে এক্সরে হলো। ডাক্তার ছবি দেখে দাঁতের স্বাস্থ্যাবস্থা বর্ণনা করলেন। একজন এসিস্ট্যান্ট কে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে অন্য রোগীর কাছে চলে গেলেন।
এসিস্ট্যান্ট ২২-২৪ বছর বয়স। খুবই সুন্দরী।
দাঁত দেখে বলল, দাঁত তো খুবই সুন্দর।
সুন্দরীরা সব কিছুতেই সুন্দর খোঁজে। জাপানিদের কাছ থেকে চোখের প্রশংসা আগে পেয়েছি, দাঁতের প্রশংসা এবার প্রথম।
-তোমার হিস্ট্রি দেখলাম, ৬ বছর আগে একবার এসেছিলে।
জ্বি।
-আক্কেল দাঁতে সমস্যা। পোকা ধরেছে। "মুশিবা"। এটা ফেলে দাও। আক্কেল দাঁত বাস্তবে কোন কাজে লাগে না। আক্কেল ও বৃদ্ধি পায় না। আর অন্যান্য দাঁতের গোঁড়ায় সামান্য টারটার জমেছে। এগুলো পরিষ্কার করে দিতে পারি।
জ্বি, করেন।
আমাকে চেয়ারে শুইয়ে দিল। আমি মুখ হা করলাম। আপনি বোকা হন বুদ্ধিমান হন, ডেন্টিস্টের সামনে মুখ হা করতেই হবে। আমি মুখ হা করে সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই সুখ স্থায়ী হলো না। আমার চোখের ওপর হাল্কা একটা টাওয়েল দিয়ে দিল। দুজনেই সুন্দর দর্শন থেকে বঞ্চিত হলাম। উইন-উইন নয়, লুজ-লুজ সিচুয়েশন।
মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আক্কেল দাঁত কে "আক্কেল দাঁত" বলে কেন? বাকি গুলো কি বেআক্কেল দাঁত?
সে একটা কিউট ডিজিটাল হাতুড়ি বাটাল দিয়ে আমার দাঁত খোদাই করতে শুরু করলো আর গল্পের মত করে আক্কেল দাঁতের ওপর একটা লেকচার দিল।
-বুঝলে আশিরু সান, তোমার এই দাঁত (আক্কেল দাঁত) কে জাপানি ভাষায় বলে "অইয়া শিরাযু হা”। মানে হলো বাপ মা যে দাঁত চেনেনা। আক্কেল দাঁত ওঠে ১৭-২৫ বছর বয়সে। শিশুর প্রথম দাঁত গজালে বা পড়লে বাপ মা খুব মনোযোগ দেয়, মনে রাখে। মানুষকে বলে বেড়ায়। গর্বের সাথে। কিন্তু আক্কেল দাঁত গজালো কি না গজালো - সে ব্যাপারে কোন খবর রাখেন না, এজন্যই এই দাঁত কে বলা হয় “অইয়া শিরাযু হা”। বাপ মার অজানা অচেনা দাঁত।
ইংরেজিতে Wisdom tooth বলার কারণ হলো এই দাঁত গুলো যখন জন্মায়, শিশুরা ততদিনে জগতের নিয়ম কানুন গুলো জেনে আক্কেল (জ্ঞানী) হয়ে যায়। আক্কেল বয়সে গজানো দাঁত কে আক্কেল দাঁত বলা হয়।
তার মানে কি? এমন ও তো লোক আছে যার আক্কেল দাঁত ওঠেনি । সে কি আক্কেল ওয়ালা না?
আমি বলি, সে যথেষ্ট আক্কেল নিয়ে জন্মেছে বলেই প্রকৃতি তাকে আর আক্কেল দাঁত দিয়ে আক্কেল ওয়ালা প্রমাণ করতে চায়নি। চেনা বামনের পৈতা লাগেনা। আক্কেল ওয়ালা দের আক্কেল দাঁত লাগে না।
আমাদের পোর্টেবল হেলথ ক্লিনিকে দাঁত এর মডিউল যোগ করার জন্য জাপানি টিম নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের কয়েকটি কমিউনিটি স্কুলে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ ভারতের অবস্থা একই। জাপানের সাথে একটা তুলনামূলক চিত্র দিচ্ছি।
জাপানে একজন লোক দিনে কতবার দাঁত ব্রাশ করেন?
-আড়াই বার। ঘুম থেকে ওঠার পর, খাবার পর, রাতে ঘুমাতে যাবার আগে।
আর আমি মাত্র একবার। সকালে ঘুম থেকে উঠে। ঘুমাতে যাবার আগে দাঁত ব্রাশ করা উচিৎ।
এই অভ্যাসটি এখনো তৈরি করতে পারিনি।আমার শাশুড়ি এ নিয়ে আমার ওপর মহা বিরক্ত। কারণ তাঁর মেয়ে ও আমার সাথে থেকে ফাঁকি দেয়া শিখেছে। সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস।
একজন জাপানিজ কতদিন পর পর দাঁতের ডাক্তারের কাছে যান?
-ছয় মাস পর পর।
আর আমি গেলাম ছয় বছর পর। আরে ভাই, দাঁতে সমস্যা না থাকলে যামু ক্যান? টেকা কি গাছে ধরে?
একজন জাপানিজ দাঁতের জন্য গড়ে কত টাকা ব্যয় করেন?
-জানিনা। তবে সারা জাপানে বছরে ২২ বিলিয়ন ডলার। তাঁর মানে জনপ্রতি বছরে ২০০ ডলার (১৬ হাজার টাকা)। বাংলাদেশে জাতীয় বাজেট বাৎসরিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের বাৎসরিক বাজেটের ৪০% জাপানিরা শুধু দাঁতকে সুস্থ রাখতেই ব্যয় করে।
ইসস।
আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত টুথ ব্রাশ ব্যবহার করিনি।
তুষের ছাই আঙ্গুলে নিয়ে ডলা দিয়ে কুলি করলে কী প্রশান্তি লাগতো। একসময় নিম ডালের মিসওয়াক ব্যবহার করা শুরু করলাম। তিতা ধরণের এই ডাল টি কামড়িয়ে মুখে পানি দিলে কেমন মিষ্টি মিষ্টি লাগতো।
তারপর আসলো সাধনা দশন।
সকাল সন্ধ্যা প্রতিদিন
আপনার দাঁতের যত্ন নিন
সাধনা দশন ব্যবহারে
রোগজীবাণু দুর করে
বিটিভির বিজ্ঞাপনগুলো আমাদের মুখস্ত ছিল।
সাত বছর বয়সে দাঁত পড়া শুরু হলো। কি যে ভয় কি যে সংশয়।
সুতা দিয়ে দাঁতের গোড়ালি পেঁচিয়ে আস্তে আস্তে টানো। নিজের দাঁত নিজে ফেলো। ডু ইট বাই ইয়োরসেলফ। এই পড়া দাঁত নিয়ে ও কাহিনি আছে।
দাঁত নিয়ে ইঁদুরের গর্ত খোঁজ। ইঁদুরের দাঁত সবচেয়ে সুন্দর। তাই ইঁদুরের কাছে গিয়ে সুন্দর দাঁতের জন্য এপ্লিকেশন করতে হবে। কবিতার মাধ্যমে।
ইঁদুররে ভাই
আমার কোদাইল্ল্যা দাঁত টা নিয়ে একটা মুগা দাঁত দে।
কী সুন্দর জাপানি কায়দার বিনয়ী প্রার্থনা।
কোদাল (স্পেইড) থেকে কোদাইল্যা আর মুগ ডাল থেকে মুগা।
সব ইঁদুর দয়ালু ছিল না। আমার দুটা দাঁত বাঁকা হয়ে উঠলো। কোদাইল্যা দাঁত। আমার মনে হয় এটা ইঁদুর আপাদের কাজ। কবিতায় শুধু ইঁদুর ভাই বলা হয়েছে। আপা বলা হয়নি। বাংলাদেশের কবিতাগুলোর মধ্যে জেন্ডার ডেস্ক্রিমিসনে ভর্তি। এদের সমাজ ব্যবস্থায় মনে হয় মহিলা ইঁদুররা নেতৃত্ব দিচ্ছে। মৌমাছির মত। নাহ গত ৩০ বছরের বাংলাদেশের মত।
ইঁদুর আপার বদ দোয়াতে এমন ভাবে দাঁত উঠলো যে সময়মত যে দাঁত গুলো পড়ার কথা ওগুলো পড়ার সুযোগ পেল না। আব্বা এক ডেন্টিস্ট নিয়ে এলেন বাসায়। উনি খয়েরি কালারের কী এক কেমিক্যাল মুখে ঢুকিয়ে দিলেন। ব্যাথা প্রশমনের জিনিশ। কিন্তু আমাদের মুখ জ্বলে শেষ। তারপর সত্যিকারের এক ইলেকট্রিক প্লায়ার্স দিয়ে দাঁত টেনে ফেলে দিলেন। আহারে আমাদের দুই ভাইয়ের কান্না।
একবার সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছোটবোনকে নিয়ে গেলাম। রুমটা অনেকটা চুল কাটার সেলুনের মত। কয়েকটি চেয়ার। সামনে আয়না।
কয়েকজন ডেন্টিস্ট মিলে প্লায়ার্স দিয়ে একজন একজন করে দাঁত ফেলে যাচ্ছেন। রক্তাক্ত অবস্থা। আমার নিজেরই ভয় লেগে গেল।
আমার ছোট্ট বোনটি আমার বাহু চেপে ধরে বলল, “ভাইয়া আমি দাঁত ফেলাবো না”। আমি ডাক্তার কে গিয়ে বললাম, আমাদের দাঁত ফেলানো লাগবে না।
আমাদের ফুকুওকা তে একটা ডেন্টাল ক্লিনিক আছে। ডাক্তার সাহেব আর্কিটেক্ট ডেকে বললেন, এমন ভাবে ডিজাইন করে দেবেন যাতে শিশুরা খুশিতে ঠ্যালায় ঘোরতে আসতে পছন্দ করে। আর্কিটেক্ট সাহেব ডিম্বাকৃতির এক বিল্ডিং ডিজাইন করে দিলেন। দেখতে স্পেস শিপের মতো। এখন আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা বাকবাকুম করতে করতে দলে দলে ভিড় করে।
আমাদের এখলাসপুরে নামকরা এক দাঁতের কবিরাজ ছিলেন। আমার দাদি। "জরিনা দাতব্য দন্ত চিকিৎসালয়"।
কেউ একজন ওনাকে খোয়াবে (স্বপ্নে) এক মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। দাঁতের সমস্যায়, বিশেষ করে সিনিয়র লোকজন দাঁত নড়ে উঠলে ওনার কাছে আসতেন। উনি মন্ত্র পড়ে দিলে দাঁত শক্ত হয়ে যেত। দাদির মন্ত্র আমরা ফাঁস করে ফেললাম। উনি শর্ত দিয়ে গেছেন এই মন্ত্র যেন আমরা কাউকে না বলি। আপনাদের ও শিখিয়ে দিচ্ছি। অনুগ্রহ পূর্বক কাউকে বলবেন না। এতে মন্ত্রের কার্যকারিতা কমে যায়।
রোগী এবং কবিরাজ দুজনে জাপানি সুমো খেলার মতো মুখোমুখি হয়ে মাটিতে বসবেন। দুহাতের প্রথম তিন আঙ্গুল মাটিতে টাচ করবেন। মন্ত্রটি পড়বেন -
অন্তরশা দন্তরশা তোমরা পঞ্চ ভাই
কেউরে ছাইড়া কেউ যাইওনা xxx এর দোহাই
মাটিতে ফু দিবেন। মাটি দিয়ে রোগী দাঁত মাজবেন। দাঁত শক্ত হয়ে যাবে। উপকার না পেলে পয়সা ফেরত দিতে হবে না। কারণ বিনামূল্যে চিকিৎসা করাতেন। নিশ্চয়ই এই চিকিৎসা মানুষের কাজে লেগেছে না হয় প্রতি বছর দাদির রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল কেন?
গ্রামের সব ঔষধ গুলোই অর্গানিক। এমন একটা অর্গানিক কথা চালু আছে। দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো থাকে আখ খেলে। কামড়িয়ে, চিবিয়ে। দাঁতের সব পরিষ্কার হয়ে যায়।
এক জামাই বাবু সদ্য বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি গেছেন।বউ তাঁর স্বামীর মুখের গন্ধ সহ্য করতে পারছেন না। বলতে ও পারছেন না। অর্গানিক সমাধান হাতে নিলেন। হাতে ১০ টাকা দিয়ে বললেন, যান বাজারে গিয়ে আখ কিনে খেয়ে আসবেন।
রাতে দেখলেন, মুখের গন্ধের তেমন পরিবর্তন নেই। জিজ্ঞাস করলেন,
এই তুমি আখ কিনে খাও নি?
-নাহ। একটা আখ দশ টাকা। আর চারটা আটি কলা ১০ টাকা। এক বেশি না চার বেশি? মোরে তুমি ঠহাইতে পারবা লা।
জাপানে বেড়ে ওঠা আমার ভাগিনি ইঁদুরের কাছে যায়নি। তাঁর দাঁত বাঁকা হয়ে উঠেছে। জাপানি ডেন্টিস্ট বললেন, স্টিলের তার লাগিয়ে দেব। সোজা হয়ে যাবে। ছয় মাস লাগবে। দশ লাখ টাকা লাগবে। মুলামুলি নেই। ইন্সিওরেন্স কাজ করবে না। তাঁর বাবা রাজি হয়ে গেল।
আমার কেন জানি মনে হয়, জাপানের চেয়ে আমাদের দেশের মানুষের দাঁত এবং চোখের অবস্থা ভাল। এরা আর্টিফিশিয়েলি সমস্যা বের করে শুধু শুধু টাকা খরচ করে সমস্যার সমাধান করে। এতে জিডিপি বাড়ে। কিন্তু দাঁতের সমস্যা কমে না। এটা আমার আক্কেল হবার পরের কথা।
লেখক :
অ্যাসোসিয়েটস প্রফেসর, ক্যিউসু ইউনিভার্সিটি,
ডিরেক্টর, গ্রামীণ কমিউনিকেশনস।