শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

বাঁশবুনিয়া গ্রাম থেকে পটুয়াখালী শহর (চার)

বুধবার, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১
বাঁশবুনিয়া গ্রাম থেকে পটুয়াখালী শহর (চার)

জেসমিন আরা বেগম :

মায়ের সংসার
এতিম হওয়ার পরে মা এসে পরলেন বৃহৎ সংসারের মাঝে। আব্বারা পাঁচ ভাইবোন, দাদা দাদি আর বড়মা (আব্বার দাদি) হলেন সংসারের সদস্য। মুরুব্বিরা সবাই মাকে স্নেহ করেন। তবে সম্পন্ন কৃষক পরিবারে অনেক কাজ থাকে। কাজে সহায়তাকারীদের সাথে বাড়ির বউদেরও কাজ করতে হয়। মা দাদির সঙ্গে সংসারের টুকিটাকি কাজ করতে শুরু করেন। দাদি কাজ পাগল মানুষ, কাজ করতে করতে গোসল করা বা খাওয়ার সময় চলে যায়, ওনার হুঁশ থাকে না। তবে কাজের ফাঁকে যখন দেখেন বউয়ের কচি মুখ শুকিয়ে গেছে, উনি বুঝতে পারেন বউয়ের খিদা লেগেছে, বলেন, 'মেরধার ঝি তুমি যাও, গোসল করে খাইয়া লও, আমি পরে খামু।' সারাজীবন দেখেছি আমার মা খিদা সহ্য করতে পারতেন না।
মা তাঁর দাদি শাশুড়ির সঙ্গে ঘুমান। সকালের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে যখন মোরগগুলো 'কুক্কুরু কু' শব্দে বাগ দেয়া শুরু করে, তখনই আমার দাদির কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। দাদি তাঁর শাশুড়িকে ডেকে বলেন, 'আম্মা, বউরে ডাইকা দ্যান'।
এদিকে বালিকা বধূ ঘুমে কাদা। দেখে বড়মার খুব মায়া হয়। উনি মায়ের কানে ফিসফিস করে বলেন, 'তুমি আর এট্টু ঘুমাও'। আর জোরে জোরে তাঁর ছেলের বউকে বলেন, 'ডাকতে তো আছি, তোমার বউ ওডে না'। আমি এই মহিলাকে পেলে তাঁকে জড়িয়ে ধরে তাঁর দুই গালে খটাশ খটাশ দুইটা চুমা দিতাম। এখন যেহেতু সেটা করা যাচ্ছে না, দোয়া করি আল্লাহ্‌ যেন তাঁকে এবং আর যারা আমার মাকে আদর যত্নে রেখেছেন তাঁদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দেন।
আমার বড় ফুপুর বিয়ে হয়েছে, আমার আব্বা আর দুই ফুপু স্কুলে যান। আমার চাচার স্কুল ভালো লাগে না। স্কুলে যাওয়ার কথা শুনলে তাঁর পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায়। দাদির কাছে গিয়ে শুরু করেন কান্না। দাদি বলেন, 'থাঊক, হকলডি তো পড়ালেহা করতেই আছে, অর পড়া লাগবে না'। চাচা তাঁর নাম সই করতে পারেন শুধু। ছোট দুই ফুপু গ্রামের স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন। গ্রামে হাইস্কুল থাকলে হয়তো আরো পড়তেন। আমার চাচা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন অনেকদিন। মুরুব্বিদের মাঝে একমাত্র তিনিই বেঁচে আছেন, তার বয়স ৯৩ বছর, এখন আর চোখে দেখেন না।
বাড়িতে মসজিদ আছে। হুজুরের কাছে সবাই আমপারা/কোরআন শরিফ পড়া, নামাজ পড়া শেখেন। এতজনের মাঝে বাতিক্রম আমার মা। মাকে পড়ার জন্য স্কুলে বা মসজিদে পাঠানো হয়নি কখনো। মুখে মুখে সুরা মুখস্ত করিয়ে নামাজ পড়া শিখানো হয়েছে। মা প্রায়ই দুঃখ করে বলেতেন যে তিনি আমার মেজ ফুপুর বয়সি (আব্বার পরের বোন), ফুপুর সাথে স্কুলে পাঠালে ফাইভ পর্যন্ত পড়তে পারতেন। আমরা হাসতাম, 'তুমি লেখাপড়া করে কি করতা, অত আগে গ্রামে বসে তো চাকরি করতে পারতা না'! কিন্তু এখন ভাবি ফাইভ পর্যন্ত পড়ালেখা করলে তাঁর ছেলেমেয়েরা যখন বাড়ি থেকে দূরে পড়তে গেলো তখন তাদের সাথে চিঠি লিখে যোগাযোগ রাখতে পারতেন। হয়তো তাঁর ছেলেরা বিদেশ থেকে চিঠি পাঠাল, আব্বা চিঠি পড়ে তাঁকে শুনালেন। মা'র হয়তো ঐ চিঠিগুলো বার বার শুনতে মন চাইতো, আব্বা অনেক ব্যস্ত মানুষ তাঁকে তো আর বারবার চিঠি পড়তে বলা যায় না। পড়তে পারলে হয়তো নিজেই দিনের মধ্যে কয়েকবার চিঠিগুলো পড়তেন। লিখতে পারলে ছেলেমেয়ের কাছে নিজে চিঠি লিখে নিজের খবরাখবর দিতে পারতেন।
লেখাপড়া না জানার জন্য মায়ের মনে অনেক দুঃখ ছিল। মাঝে মাঝে বলতেন, 'অ্যাতোগুলা ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে মানুষ হইল, মাঝে মাঝে কাছে গিয়া বসে পড়লেও তো মেট্রিক পাশ করতে পারতাম'। কিন্তু সংসারের কাজ করতে করতে মাদের আর সময় কোথায় নিজের দিকে তাকানোর বা নিজের জন্য ভাবার!
আজ মায়ের নামে আমাদের বাড়ি সংলগ্ন আব্বার প্রতিষ্ঠিত, মেহেরুন্নেসা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অনেক মেয়েরা লেখাপড়া করে উপকৃত হচ্ছে। এই স্কুলটার অভাবে আমার বড় দুইবোন ক্লাস ফাইভের পরে আর নিয়মিতভাবে ক্লাস করতে পারেননি। কম বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে। পরে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পাশ করেছেন। বড় আপা কোন চাকরি করেননি। মেজো আপা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন, বর্তমানে অবসরে আছেন।
এখন আমাদের গ্রামের মেয়েরা আর দুঃখ করবে না, যে একটা স্কুলের অভাবে তাদের লেখাপড়া হয়নি।

লেখক পরিচিতি :

জেসমিন আরা বেগম, 
কেমিকৌশলী, ১৩ তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য এবং বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। 
প্রাক্তন উপ-পরিচালক,  বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, (বিপিএটিসি)।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল